মৃত ব্যক্তি যদি কুরবানি করার ওসিয়ত করে যায় তাহলে তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তার উত্তরাধীগণ ওসিয়ত পালনার্থে তার পক্ষ স্বতন্ত্রভাবে থেকে কুরবানি করবে। অন্যথায় মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আলাদাভাবে কুরবানি করা অধিকাংশ আলেমের মতে ঠিক নয়। কেননা এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীদের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা ও আমল পাওয়া যায় না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় তাঁর প্রাণ প্রিয় স্ত্রী খাদিজা রা., প্রিয় চাচা হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব রা., তিন ছেলে ও তিন মেয়ে দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনি তাদের পক্ষ থেকে কখনও স্বতন্ত্রভাবে কুরবানি করেন নি। কোনও সাহাবী এমনটি করেছেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তবে কুরবানি করার সময় যদি পরিবারের জীবিত ও মৃত সকলকে নিয়তে শরিক করা হয় তাহলে আল্লাহ তাআলা সকলকে সওয়াব দান করবেন ইনশাআল্লাহ।
যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
أبو سعيد رضي الله عنه: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم أتى يوم النحر بكبشين أملحين فذبح أحدهما فقال هذا عن محمد وأهل بيته وذبح الآخر فقال هذا عمن لم يضح من أمتي
আবু সাঈদ খুদরি রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরবানির দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট সাদা-কালো রঙ বিশিষ্ট দুটি দুম্বা আনা হল। তিনি দুটির মধ্যে একটি জবেহ করে বললেন, এটি মুহাম্মদ এবং তার পরিবারের পক্ষ থেকে এবং আরেকটি জবেহ করে বললেন, এটি আমার উম্মতের যারা কুরবানি করে নি তাদের পক্ষ থেকে।” [মুসনাদ আহমদ]
‘পরিবার’ এর মধ্যে জীবিত ও মৃত সকলেই অন্তর্ভুক্ত।
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে স্বতন্ত্রভাবে কুরবানি করার ব্যাপারে পূর্বসূরি আলেমদের অভিমত:
ইমাম মালিক মৃত বাবা-মা’র পক্ষ থেকে কুরবানি করাকে অপছন্দ করতেন। যেমন:
روي محمد عن مالك قال: لا يعجبني أن يضحي عن أبويه الميتين، قال في الشرح: لكون الأضحية من أحكام الحي اهـ
মুহাম্মদ বর্ণনা করেন ইমাম মালিক থেকে। তিনি বলেন, “মৃত বাবা-মার পক্ষ থেকে কুরবানি করাকে আমি পছন্দ করি না।”
ব্যাখ্যাকার বলেন, তা এই কারণে যে, “কুরবানি করা জীবিত ব্যক্তিদের আহকামের অন্তর্ভুক্ত।” [আল মুন্তাকা শারহুল মুআত্তা]
শাফেয়ী মাজহাবের ফিকাহর কিতাবে এ কথা বহু স্থানে উল্লেখিত হয়েছে যে,
لا يصل إلى الميت ثواب الأضحية ولا القراءة وحج التطوع
“কুরবানি, কুরআন তিলাওয়াত এবং নফল হজ্জের সওয়াব মৃত ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছে না।”
আরও উল্লেখিত হয়েছে:
وكره فعلها، أي الأضحية عن ميت كالعتيرة
“আর তিনি (ইমাম শাফেয়ী রহঃ) মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কুরবানি করাকে আতীরা (عتيرة) তথা জাহেলী যুগে মৃতদের উদ্দেশ্যে ছাগল জবেহ করার মতই অপছন্দ করতেন।” [মাওয়াহিবুল জালীল শরহু মুখতাসার খালীল খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৩৬৮]
হানাফি মাজহাবের ফিকাহর গ্রন্থ بدائع الصنائع আল বাদায়েউস সানায়ে গ্রন্থে বলা হয়েছে:
إذ الأضحية عن الميت لا تجوز
“মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা জায়েজ নেই।” [খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৭২]
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. থেকে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানির ব্যাপারে অনুমতি বা নিষেধাজ্ঞা কোনাটাই পাওয়া যায় না। যদিও হাম্বলি মাজহাবের কতিপয় আলেম মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দানের উপর কিয়াস করে কুরবানি করাকে বৈধ বলেন।
ইমাম তিরমিযি রহ. জামে তিরমিযিতে বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেছেন,
أحب إلي أن يتصدق عنه ولا يضحى عنه وإن ضحى فلا يأكل منها شيئا ويتصدق بها كلها
“মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-সদকা করা আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়। কিন্তু কুরবানি করা যাবে না। তবে যদি কেউ কুরবানি করে তবে যেন তার মাংস না খায় বরং সবটুকু গরীবদের মাঝে বিলি-বণ্টন করে দেওয়া হয়।”
[তিরমিযি, মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করা অধ্যায়]।
অবশ্য একদল আলেম বলেন, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে যেহেতু দান করা সহীহ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত সেহেতু কেউ যদি কুরবানি করে তা গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেয় তাহলে তা জায়েজ আছে। এ ক্ষেত্রে সেখান থেকে কুরবানি দাতা বা তার পরিবার কোন কিছুই গ্রহণ করতে পারবে না। বরং পুরোটাই গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করে দিতে হবে।
কিন্তু মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে কুরবানি করার পক্ষ থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবীদের পক্ষ থেকে কোনও দলিল পাওয়া যায় না। এমনকি মাজহাবের ইমামগণও বৈধ বলেন নি-যেমনটি আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি।
সুতরাং ১ম মতটি অধিক বিশুদ্ধ। মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কুরবানি করার কারণে তারা যদি কবরে লাভবান হত তাহলে সাহাবায়ে কেরাম এ ক্ষেত্রে সবার অগ্রে থাকতেন। কিন্তু তারা তা করেন নি। অত:এব তাদের আগ বাড়িয়ে কিছু করা আমাদের জন্য সমীচীন হতে পারে না।
আল্লাহু আলাম।