Table of Contents
মৃত্যু প্রথম ধাপ
প্রথম ধাপের নাম ইয়াউমুল মাউত!
এই দিনেই মানুষের জীবনের সমাপ্তি ঘটবে, হায়াত ফুরিয়ে যাবে। আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিবেন জমিনে গিয়ে রুহু কবজ করে নিয়ে আসতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কেউ এই দিন সম্পর্কে জানেনা। এমনকি যখন এইদিন চলে আসবে সেইদিন ও সে জানবে না আজ তার মৃত্যুর দিন।
মৃত্যুর বিষয়টি উপলব্ধি না করা সত্বেও দেহে কিছু পরিবতর্ন অনুভব করবে। মুমিনের অন্তরে প্রশান্তি অনুভব হবে আর পাপিষ্ঠ বুকে খুব চাপ অনুভব করবে। এই স্তরে শয়তান এবং দুষ্ট জীন ফেরেশতাদের নামতে দেখবে। কিন্তু মানুষ তাদের দেখবেনা। এই পদক্ষেপটি কোরআনে বর্ণিত হয়েছে
وَاتَّقُواْ يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللّهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ
ঐ দিনকে ভয় কর, যে দিন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোন রূপ অবিচার করা হবে না।
সূরা বাক্বারা-২৮১
মৃত্যু দ্বিতীয় ধাপ
এরপর আসবে দ্বিতীয় ধাপ!
এটা হচ্ছে ধীরেধীরে রুহু কবজ করার পালা। এই ধাপে রুহ পায়ের পাতা থেকে আরোহণ শুরু করে গোছা, হাটু, পেট, নাভি ও বুকের উপর হয়ে মানব দেহের “তারাক্বী” নামক স্থানে পৌছে যায়।
এই সময় মানুষ ক্লান্তি ও অস্থিরতা অনুভব করেন এবং একধরণের অসহনীয় চাপ অনুভব করেন। তখনও তিনি জানতে পারেন না যে তার রুহু বের হয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যু তৃতীয় ধাপ
এই ধাপের নাম ” তারাক্বী ” কোরআনে এই স্তরের কথা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে ;
كَلَّا إِذَا بَلَغَتْ التَّرَاقِيَ. وَقِيلَ مَنْ رَاقٍ. وَظَنَّ أَنَّهُ الْفِرَاقُ. وَالْتَفَّتِ السَّاقُ بِالسَّاقِ
‘কখনও না, যখন প্রান কণ্ঠাগত হবে। এবং বলা হবে, কে ঝাড়বে। এবং সে মনে করবে যে, বিদায়ের ক্ষন এসে গেছে’। পায়ের গোছা অন্য গোছার সাথে জড়িয়ে যাবে।
সূরা কিয়ামাহ-২৬-২৯
তারাক্বী বলা হয় কণ্ঠনালিরর নিচে ২ কাধ পর্যন্ত বিস্তৃত হাড়কে।
“কে ঝাড়বে” অর্থাৎ আত্মিয়-স্বজনদের কেউ কেউ বলবে : ডাক্তার ডাকি, অন্যজন বলবে ইমারজেন্সিতে কল করি, আবার কেউ বলবে কোরআন পড়ে ফু দেই।
এই পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ জীবনে ফিরে আসার আশা করতে থাকবে । সে বিশ্বাসই করতে চাবেনা যে রুহু তার দেহ ত্যাগ করছে!!
(وَظَنَّ أَنَّهُ الْفِرَاقُ সে মনে করবে, বিদায়ের ক্ষন এসে গেছে) অর্থাৎ সে এখনো মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত নয়। সে বাচার চেষ্টা করতে থাকে।
কিন্তু আল্লাহ তা’লা বলেন :(وَالْتَفَّتِ السَّاقُ بِالسَّاقِ) পায়ের গোছা অন্য গোছার সাথে জড়িয়ে যাবে)
অর্থাৎ মৃত্যুর বিষয় এখন চূড়ান্ত। রুহু গোছাদ্বয় থেকে বেরিয়ে গেছে।সে আর পা নাড়াতে পারবেনা।এবং রুহু দেহ থেকে বের হয়ে তারাক্বীতে পৌছে গেছে।
(“كَلَّا إِذَا بَلَغَتِ التَّرَاقِيَ”)
‘কখনও না, যখন প্রান কণ্ঠাগত হবে!
মৃত্যু চতুর্থ ধাপ
অতঃপর আসবে চতুর্থ ধাপ। এই ধাপের নাম হুলক্বুউম :
মৃত্যুর এটাই শেষ স্তর এবং মানুষের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের কঠিন স্তর। এই সময় তার চোখেরপর্দা সরিয়ে দেওয়া হবে।
এবং সে চারপাশে উপস্থিত ফেরেশতাদের দেখতে পাবে। এখান থেকেই আখেরাত দর্শনের স্তর শুরু হবে।
لَقَدْ كُنتَ فِي غَفْلَةٍ مِّنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنكَ غِطَاءكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيدٌ
তুমি তো এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। এখন তোমার কাছ থেকে যবনিকা সরিয়ে দিয়েছি। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষ্ন।
সূরা ক্বফ
আয়াত নং-২২
এই স্তরকে হুলক্বুউম নামকরণ করা হয়েছে আল্লাহর কালামের কারনে :
فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ . وَأَنتُمْ حِينَئِذٍ تَنظُرُونَ . وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنكُمْ وَلَكِن لَّا تُبْصِرُونَ
অতঃপর প্রান যখন কণ্ঠাগত হয় তখন তোমরা তাকিয়ে থাক। তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না।
সূরা ওয়াকিয়াহ – ৮৩-৮৫
আল্লাহ তার চতুর্পাশে উপস্থিত ব্যক্তিদের সম্বোধন করে বলছেন ; তোমরা যেখানে আছো সেও সেখানেই আছে। সে যা দেখতে পাচ্ছে তোমরা তা দেখতে পাচ্ছ না।
হয়তো সে আল্লাহ তাআলার রহমত দেখছে অথবা মাআ’যাল্লাহু আল্লাহর আজাব এবং গজব দেখছে যদি সে পাপী হয়।
এজন্যই আপনারা তাকে দেখবেন নির্দিষ্ট একটি জায়গা এবং এক বিন্দুতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে।
وَنَحْن أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لَا تُبْصِرُونَ
অর্থাৎ আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটতর কিন্তু তোমরা তা দেখতে পাও না। মানুষের রুহ কবজ এর সময়টা জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত। কেননা তখন সে আল্লাহর সকল প্রতিশ্রুতি ও ভীতি দেখতে পায়। ফেরেশতাদের দেখতে পায়। জীবনে যত আমল করেছে তা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আর এই অবস্থায় মৃত্যুর ফেতনা ঘটে যায়।
শয়তান এই ফেতনায় প্রবেশ করে এবং আকিদায় সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। আল্লাহর ব্যাপারে, নবীর ব্যাপারে, দ্বীনের ব্যাপারে ও কোরআনের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে তার অন্তরে।
এবং সে তার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকে যেন সে কাফের হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। এইসময় শয়তান নিশ্চিত যে এটা এই মানুষটির শেষ মুহূর্ত এবং মালাকুল মাউত তার নিকটবর্তী।
এইজন্য সে তার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী চূড়ান্ত আঘাত হানতে থাকে। এজন্যই কোরআন আমাদের মৃত্যুর ফেতনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় নিতে বলছে :
وَقُل رَّبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ . وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَن يَحْضُرُونِ
আপনি বলুন ;হে আমার রব! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি শয়তানের প্ররোচনা থেকে। এবং আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি তাদের উপস্থিতি থেকে।
সূরা মুমিন- ৯৭-৯৮
তুমি যদি ইসলাম অনুযায়ী তোমার জীবন পরিচালিত করো এবং তোমার অন্তরে আল্লাহ তার রাসুল এর ভালোবাসা থাকে তাহলে তুমি এই অবস্থায় দুনিয়া থেকে বের হবে। মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত যখন চলে আসবে তখন শয়তান তার কোন একজন নিকটাত্মীয়ের আকৃতিতে উপস্থিত হবে যিনি আগেই মারা গেছেন।
সে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বলবে; আমি তোমার পূর্বে মারা গিয়েছি।
ইসলাম সত্য ধর্ম নয় এবং নবী সত্য দ্বীন নিয়ে আসেননি। এবং অবশ্যই তোমাকে বলবে; তুমি সবকিছু অস্বীকার করো।
এই পরিস্থিতির চিত্র আল্লাহ কোরআনে বর্ণনা করেনঃ
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ
তাদের তুলনা হচ্ছে শয়তান যখন সে মানুষকে বলবে তুমি কুফরি করো ।যখন মানুষ কুফরি করবে তখন শয়তান বলবে ; তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই ।আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।
সূরা হাশর- ১৬
মৃত্যু পঞ্চম ধাপ
এরপর পঞ্চম ধাপ শুরু হবে !
যেখানে আজরাইল আলাইহিস সালাম প্রবেশ করবে। এই স্তরে মানুষ পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারবে সেকি জান্নাতি না জাহান্নামী। সে তার আমলের ফলাফল দেখবে এবং তার পরিণতি সম্পর্কে জানতে পারবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই স্তর নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন।
বিশেষভাবে যারা বিভিন্ন গুনাহে লিপ্ত ছিল এবং তাওবা না করেই পাহাড় সমূহ পাপ নিয়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হয়েছে।
وَالنَّازِعَاتِ غَرْقًا
শপথ সেই ফেরেশতাদের যারা নির্মমভাবে(রুহ) টেনে বের করে।
সূরা নাযিয়াত-০১
জাহান্নামে একদল ফেরেশতা থাকবে যারা আগুনের কাফন প্রস্তুত করে এবং খুব নির্দয়ভাবে পাপী ব্যক্তির রুহ কবজ করে। আরেকটি আয়াতে এই কঠিন পরিস্থিতির চিত্র বর্ণিত হয়েছে ;
فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمْ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ
ফেরেশতারা যখন তাদের মুখমন্ডল এবং পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে তাদের প্রাণ হরণ করবে তখন তাদের কী দশা হবে?
সূরা মোহাম্মদ-২৭
মৃত্যু ষষ্ঠ ধাপ
এই ধাপের পর শুরু হবে ষষ্ঠ ধাপ!
এই ধাপে মানুষের রুহ প্রস্তুত হয়ে তারাক্বীর উপর সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যাবে। এবং রুহ বের হওয়ার জন্য এবং আজরাইল আলাইহিস সালাম এর নিকট আত্মসমর্পণের জন্য নাকে মুখে অবস্থান করবে।
বান্দা যদি পাপীষ্ঠ হয় তখন আজরাইল তাকে বলবে; হে নিকৃষ্ট আত্মা! তুই আগুন ও জাহান্নামের এবং ক্রোধান্বিত ও প্রতিশোধপরায়ন রবের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আস।
তখন তার আভ্যন্তরীণ চেহারা কালো হয়ে যাবে। এবং চিৎকার করে বলবে ;
حَتَّى إِذَا جَاء أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ
হে আমার রব! আমাকে পুনরায় পাঠান যাতে আমি সৎকাজ করি যা আমি পূর্বে করিনি।
সূরা মুমিন-৯৯
কারন আমি নেককাজ করতে পারিনি। তখন সে শুনতে পাবে;
لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِن وَرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ
যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনই নয়, এ তো তার একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।
সূরা মুমিন-১০০
না এটা হতে পারেনা। এটা তো তার একটি উক্তিমাত্র। তাদের সামনে বারযাখ থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।
আল্লাহ তা’লা আরও বলেন;
وَجَاءتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ
মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যই আসবে, যা থেকে তুমি পালাচ্ছিলে।
সুরা ক্বফ-১৯
قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে, অতঃপর তোমরা অদৃশ্য, দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন সেসব কর্ম, যা তোমরা করতে।
সূরা জুমআ’হ-০৮
قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ
আপনি বলুন; যেই মৃত্যু থেকে তোমরা পালায়ন কর সেই মৃত্যুর সাথে তোমাদের সাক্ষাত হবেই।
সর্বশেষে আমরা চিন্তা করে দেখতে পারি,
আমরা কেন মৃত্যুকে ভয় পাই?
এর সহজ এবং সাবলীল উত্তরঃ কারণ তোমরা দুনিয়াকে আবাদ করেছ আর আখেরাতকে বরবাদ করেছ।
যে মৃত্যুকে বেশি স্মরণ করবে সে আখেরাতের জন্য বেশি প্রস্তুত থাকবে।
أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ
“তোমরা সকল স্বাদ কর্তনকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করো।
লেখাটি লিখেছেন
Fariza Binte Abdul Hamid