Writing

বেদনার বৃষ্টি

বেলা নয়টা! ঝরছে বাদল!
দু’তিনদিন ধরে আকাশের কান্না থামছেনা। এ কান্নার যেনো নেই শেষ। অঝোর ধারে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। তবে আকাশ কাঁদলেও বজ্রপাত তেমন আর্তনাদ করছে না। তাই বজ্রের ধ্বনি শুনে বুক কেপে উঠার ভয় মোটেও নেই।
বৃষ্টি রবের দেওয়া বিশেষ উপহার।

একটানা বৃষ্টি আমার কাছে চরম সুখের। বৃষ্টি মানেই অপরূপ ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। বৃষ্টি মানেই রিমঝিম শব্দে হৃদয়ে শিহরণ জাগা। বৃষ্টি দেখলেই মন চায় ভাপ ওঠা শর্ষে ইলিশের গন্ধে প্রাণখানা জুড়িয়ে জিবের তৃপ্তি মেটাতে। বৃষ্টি মানেই আমার কাছে খিচুড়ি আর ভর্তা আহার। বৃষ্টির দিন মানেই একটু ভাজাপোড়া।
মা আলু পটল নিয়ে বসেছেন রান্না ঘরে।

— কি করবা আলু পটল দিয়ে?
— গরুর গোস্তে কয়েক টুকরো দিবো।
— আজ এসব খাবো না। খিচুড়ি রান্না করো। সাথে গরুর গোস্ত ফ্রাই, ডিম আর সালাদ।

আমার সাথে সুর মিলালো রেনু আন্টি। তিনি গরুর গোস্তগুলো বটির সাহায্যে টুকরো করছিলেন।
হ্যা হ্যা খিচুড়ি রান্না হোক। তাহলে আমার পরিবারও আজ গরুর গোস্ত, ডিম, খিচুড়ি খেতে পারবে। হেসে হেসে বললো আন্টি। মা ভালো- মন্দ যাই রান্না করেন ওনাকে দিবেন। এমনকি ঘরে মেহমানরা আসার সময় কতকিছু আনেন। ওখান থেকেও ওনার জন্য কিছু রেখে দেন। এটা আমার মায়ের অভ্যাস।

তিনি আমাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে থাকেন। রোজ সকালে আসেন। মাকে সাহায্য করেন। দুই ছেলেমেয়ে আর আংকেলকে নিয়ে উনার সংসার। আন্টি বললেন, বৃষ্টি মানেই তোমাদের কাছে খিচুড়ি ভোজন করা। জানালায় পাশে বসে বৃষ্টিমুখর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা। চারদিকে নীরব নির্ণয় এক সিক্ত পরিবেশে পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া হলেও আমাদের জীবনে এর অর্থ বড়ই করুণ। আমরা একটি আলোঝলমল রোদেলা দিনের অপেক্ষায় থাকি প্রতিনিয়ত।
আমার বাসার কি অবস্হা জানো?

একটানা বর্ষনে কলোনীতে পানি ঢুকে আমাদের রুম পায়েরগোড়ালি পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে৷ মাথার উপর অবিরাম টপটপ করে বড় বড় ফোটার পানি পড়ছে ভাঙা টিন গড়িয়ে।
জিনিসপত্র সব উপরে তুলে রেখেছি। সারারাত কেউ ঘুমাতে পারি না। পানি পরিষ্কার করতে হয় রাতভর। ঘরের চারপাশ কর্দমাক্ত হয়ে আছে। এটা আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। এমনিতেই নানান টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে কোনরকমে টিকে আছি এ শহরের বুকে। তার উপর বৃষ্টির কারনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে।

চোখের পানি লুকিয়ে আন্টি আমায় বলে যাচ্ছেন,
তোমার আংকেল দুটি ভবনে ইট কংকরের কাজ করতেন। লকডাউনে মালিকরা কাজ বন্ধ করে দেওয়াতে তিনি মাথায় হাত রেখে সংসার খরচের চিন্তায় দিব্যি ছেলেমেয়েদের বকে যাচ্ছেন। লকডাউন মানেই তো গরীবের মরণ। গরীবের কান্না কোন ভদ্রলোক দেখেনারে!

এ বৃষ্টি তোমাদের আনন্দ ও সুখ – শান্তি দিলেও আমাদের মতো গরিবের কপালে দুঃখ- দুর্দশা ও হতাশার চিত্র এঁকে দেয়। বৃষ্টি মানেই ভোগান্তি! আল্লাহ কেন আমাদের গরিব বানিয়েছেন? আর পারছিনা কষ্ট সহ্য করতে! পারছিনা জামাই ঘ্যনঘ্যনানি শুনতে! পারছিনা বাচ্চাদুটোর আর্তনাদ সহ্য করতে!
আন্টির এসব বর্ননা শুনে মনের চারপাশে যেনো কান্নারই সুর বাজছে।

আন্টিকে সান্ত্বনা দেয়ার উদ্দেশ্যে বললাম, জানেন আন্টি?
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টির সময় কি দোয়া করতেন?
আন্টি ভাবলেশহীন হয়ে বললেন, কোথ থেকে জানবো মা? পড়ালেখা তো সেই কয়েক যুগ আগেই ছেড়ে দিয়েছি।

আমি বললাম : প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টি দেখলে ভীষণ খুশি হতেন।
তিনি তখন দোয়া পাঠ করতেন যার অর্থ খুব সুন্দর আন্টি। রাব্বি আল্লাহ্‌কে ডেকে বলতেন, হে আল্লাহ! আপনি মুষলধারায় যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারি হয়।’

আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ের একটি চমৎকার ঘটনা ঘটেছিল। আপনাকে সেই কাহিনী শুনাই, এক ব্যক্তি জুমআর দিন দারুল কাজা অর্থাৎ বিচার করার স্থানের দিকের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেই ঠিক যেখানে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন সেখানে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল-

‘হে আল্লাহর রাসুল! ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আল্লার কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাদের বৃষ্টি দান করেন।
তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাত তুলে ৩ বার দোয়া করলেন-

‘হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন।

এ দোয়ার পর পর সাহাবারা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, হঠাৎ সাল’আ পর্বতের ওই পাশ থেকে ঢালের মত মেঘ উঠে আসে এবং মধ্য আকাশে এসে ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এরপরে টানা ৬ দিন সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি।

একটু থেমে টেবিল থেকে ১ গ্লাস পানি পান করে নিলাম। অতঃপর আবারো বলা শুরু করলাম,
এরপরের জুমআয় ঠিক একই দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি প্রবেশ করল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন।
‘হে আল্লাহর রাসুল! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কাজেই আপনি বৃষ্টি বন্ধের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দুই হাত তুলে এভাবে দোয়া করলেন-

‘হে আল্লাহ! আমাদের আশে পাশে, আমাদের উপর নয়। হে আল্লাহ! টিলা, মালভূমি, উপত্যকায় এবং বনভূমিতে বৃষ্টি বর্ষণ করুন।’
অতঃপর বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়।
[বুখারি-হাদীস ১০১৪]

বুঝলেন আন্টি, বৃষ্টিতে হতাশ হবেন না। বেশি বেশি মহান রবের দরবারে দোয়া করবেন। নিজের নেক চাহিদা গুলো খুব খুব করে চাইবেন। বৃষ্টির ক্ষতি থেকে মহান রবের কাছে পানাহ চাইবেন। দেখবেন কোনো এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় খুলে যাবে দোয়া কবুলের দরজা।
ইনশা আল্লাহ।

লিখেছেন

ইসলামীক লেখক ও গবেষক
আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।
“Alhamdulillah For Everything”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture