আমাদের দেশে একধরণের বিয়ে আছে, সেই বিয়ে হলো বাবার বন্ধুর ছেলে/মেয়ের সাথে বিয়ে। সন্তান জন্মের পর বাবা তার বন্ধুর সাথে এক ধরণের কথা দিয়ে ফেলেন যে, আমার মেয়ের/ছেলের সাথে তোমার মেয়ে/ছেলের বিয়ে দেবো।
আবার আরেক ধরণের বিয়ে আছে, যেখানে মেয়ের বাবা এবং ছেলের বাবা সবকিছু ‘ফাইনাল’ করে ফেলেন, মেয়েকে শুধু ‘কবুল’ বলতে বলেন। তারা এমনভাবে সবকিছু ঠিক করে ফেলেন যে, মেয়ের তখন আর মতামত দেবার সুযোগ থাকে না। মেয়ে যদি বলে, “বাবা, এই বিয়েতে আমার মত নেই”, তাহলে তাকে শুনানো হয় যে বাবার মান-ইজ্জত, ফ্যামিলির স্ট্যাটাস, কথা দেবার পর কিভাবে মুখ দেখাবো এসব কথা।
যে মেয়েটা সারাজীবন একজনের সাথে সংসার করবে, বিয়ের পর শারীরিক-মানসিকভাবে যে বাড়িতে অবস্থান করবে, এমন সিদ্ধন্তে তার মতামত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জানা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তার মতামতই মুখ্য। এমন না যে, তার মতামত জানাটা স্রেফ ফর্মালিটি।
একজন মেয়ে যদি কারো সাথে বিয়েতে দ্বিমত করে, সে যদি বলে ‘আমি অমুককে বিয়ে করবো না’, তাহলে বাবার দিকে চেয়ে, পরিবারের দিকে চেয়ে বিয়ে দেবার প্রশ্ন আসে না। তাকে বিয়ের ব্যাপারে জোর করা যায় না। একজন মেয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তার বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হতে পারে বা আপত্তি জানাতে পারে। তার মতামত এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; বাবার বন্ধুকে কথা দেয়া না।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“কুমারী (অবিবাহিত) মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবে না, যতোক্ষণ না তার অনুমতি নেয়া হবে।”1
মেয়ে প্রস্তাবের ক্ষেত্রে যদি আপত্তি না জানায়, যদি চুপ করে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হয় সে রাজি। নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একই হাদীসে মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
একজন মেয়ের আপত্তি সত্ত্বেও বাবা চাইলে তাকে বিয়ে দিতে পারেন না। একবার এক যুবতী মেয়ে এসে নবিজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললো, “আমার বাবা তার ভাতিজার দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য আমাকে তার সাথে (বাবার ভাতিজা) বিয়ে দিয়েছেন।”
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরো ঘটনাটি শুনে বুঝলেন যে, বিয়েতে মেয়ের মতামত নেয়া হয়নি এবং সে রাজি ছিলো না। তিনি এখন পুরো বিষয়টি মেয়ের এখতিয়ারে ছেড়ে দেন। মেয়ে চাইলে বিয়ে রাখতে পারে। মেয়ে চাইলে বিয়েটি ভেঙ্গে দিতে পারে; যেহেতু তার অমতে বিয়ে।
তখন মেয়েটি বললো:
“আমার বাবা যা করেছেন, আমি তা বহাল রাখলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিলো, মেয়েরা জেনে নিক যে, বিয়ের ক্ষেত্রে বাবাদের কোনো এখতিয়ার নেই।”
[সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৮৭৪]
বাবার মতেই মেয়ে বিয়ে করবে, মেয়ের কোনো মতামত থাকবে না; ইসলাম এটার বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে একজন মেয়েকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তার স্বাধীন মতামত পেশ করার। স্বাভাবিক অবস্থায়, যৌক্তিক কারণে মেয়ে যদি কোনো প্রস্তাবে ‘না’ বলে, সেক্ষেত্রে মেয়ের চৌদ্দগুষ্টি ‘হ্যাঁ’ বললেও কাজে আসবে না। মেয়ের মতামতই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) এক্ষেত্রে একটি যৌক্তিক আর্গুমেন্ট পেশ করেন।
তিনি বলেন:
“বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ে উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তার মতের বিপরীতে বিয়ে দেয়া কমন সেন্সের পরিপন্থী। আল্লাহ তো সেই মেয়েকে তার অনুমতি ছাড়া তাকে জোর করে কিছু খাওয়ানো, পরানোর অনুমতি দেননি, সেক্ষেত্রে কিভাবে তার অনুমতি ছাড়া তাকে বিয়ের অনুমতি দিবেন?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আল্লাহ ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করেন, কিন্তু মেয়েটি যদি তার স্বামীকে স্বামী হিশেবে মেনে নিতে না চায়, স্বামীকে ঘৃণা করে, তাহলে কিভাবে তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠবে?”2
নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সীরাতে প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা আছে।
মদীনার অলিতে গলিতে এক যুবক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। যেই তাঁকে এভাবে দেখছে তার মায়া লাগছে। মদীনার সমাজে একজন মেয়ের পেছনে কেউ এভাবে কেঁদে কেঁদে বেড়ায়?
তাঁর নাম মুগীস। রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবী এবং একজন দাস। বারীরা নামের এক মেয়ের পিছু পিছু তিনি ঘুরছেন। বারীরা ছিলো তাঁর স্ত্রী। তাঁকে তালাক দিয়ে সে চলে গেছে। কিন্তু, বারীরার চলে যাওয়া মুগীস মেনে নিতে পারেননি। বাচ্চা ছেলেদের মতো বারীরা পিছু পিছু ঘুরছেন। কান্না করতে করতে তাঁর দাড়ি পর্যন্ত ভিজে গেছে।
মুগীসকে এই অবস্থায় দেখে রাসূলেরও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মায়া হলো। মুগীসের আবেগটি তিনি অনুভব করলেন। তাঁর সাথে থাকা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন, “ও আব্বাস! বারীরার প্রতি মুগীসের ভালোবাসা এবং মুগীসের প্রতি বারীরার অনাসক্তি দেখে তুমি কি আশ্চর্যান্বিত হওনা?”
মুগীসের কান্না দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পক্ষ নিয়ে বারীরার কাছে গেলেন। বারীরারকে গিয়ে বললেন, “তুমি যদি তাঁর কাছে আবার ফিরে যেতে!”
বারীরা ছিলেন বেশ বুদ্ধিমতী। তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আমাকে আদেশ দিচ্ছেন?”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কথাটি পরিস্কার করেন। “না, আমি কেবল সুপারিশ করছি।”
বারীরা যখন বুঝলেন এটা রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ না, তিনি চাইলে নিজের মতের উপর চলতে পারেন তখন বললেন,
“আমি তাঁকে (মুগীসকে) চাই না।”3
বারীরা যখন বুঝলেন যে, নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘নবী হিশেবে’ তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন না, স্রেফ একজন সমাজের মানুষ হিশেবে সুপারিশ করছেন, তখন তিনি নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুপারিশ গ্রহণ করলেন না। এটা গ্রহণ-বর্জন করার ব্যক্তিগত এখতিয়ার তাঁর ছিলো।
কিন্তু, নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশটি যদি শার’ঈ নির্দেশ হতো, তাহলে বারীরা সেটা মানতে বাধ্য ছিলেন। ব্যক্তিগত আবেগের জায়গা থেকে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারীরাকে চাপ প্রয়োগ করেননি।