আজ থেকে ২০০ বছর আগে কোথাও ভ্রমণ করা এতো সহজ ছিলো না। এক মহকুমা থেকে আরেক মহকুমায় যেতে কয়েকদিন লাগতো। যারা হজ্জ করতে যেতেন, হজ্জে যাওয়া-আসা মিলিয়ে বছরখানেক লেগে যেতো।
১১৩০ খ্রিস্টাব্দ, ৫২৫ হিজরী। আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগের ঘটনা। চিন্তা করুন, তখনকার সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন ছিলো। কোনো প্লেন ছিলো না, বাস, কার, ট্রেন ছিলো না। বিশ্ব ভ্রমণকারী ইবনে বতুতার জন্মের প্রায় দুশো বছর আগের ঘটনা।
চীনের কাশগড়ে একজন নারী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র। চীনে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর পিতৃপুরুষের মাতৃভূমি ছিলো স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া। স্পেনে তথা আন্দালুসের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সা’দ আল খায়র রাহিমাহুল্লাহ পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান চীনে। ফাতিমার বাবা সা’দ আল খায়র ছিলেন একজন আলেম। ফলে, ফাতিমার পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় বাবার কাছে।
সা’দ আল খায়র নিজে যেমন মেয়েকে পড়ান, তেমনি তাঁর শিক্ষকদের কাছেও মেয়েকে পড়াতে নিয়ে যান।
[আল-মুনজিরী, তাকমিলাহ: ২/১৫]
তৎকালীন বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিলো বাগদাদ, ইস্পাহান, দামেস্ক, বুখারা, নিশাপুর, কায়রো প্রভৃতি অঞ্চল। ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র তখনকার সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ করেন।
ইস্পাহানের বিখ্যাত নারী মুহাদ্দিস ফাতিমা আল-যুযদানিয়্যাহর কাছে তিনি ইমাম আত-তাবরানী রাহিমাহুল্লাহর বিখ্যাত দুটো হাদীসগ্রন্থ ‘মাজমু আল-কাবীর’ ও ‘মাজমু আস-সাগীর’ পড়াশোনা করেন। বর্তমানে হাদীস গ্রন্থ দুটো প্রকাশিত হয়েছে ৩৯ খণ্ডে।
[আকরাম নদভী, আল-মুহাদ্দিসাত, পৃষ্ঠা ৯৩]
ছাত্রী ফাতিমা তাঁর শিক্ষিকা ফাতিমার কাছে ৩৯ খণ্ডের হাদীসের কিতাব পড়াশোনা করেন। সেই পড়াশোনা শুধু পড়ে যাওয়া ছিলো না। হাদীসের অর্থ বুঝানো, হাদীসের প্রয়োগ বুঝানো তথা ফিক্বহের জ্ঞানও শেখানো হতো।
ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র ইরান থেকে ইরাকে যান। ইস্পাহান থেকে বাগদাদ। বর্তমান সময়ের রোডম্যাপ অনুযায়ী ইস্পাহান থেকে বাগদাদের দূরত্ব প্রায় ১০০০ কিলোমিটার; ঢাকা থেকে কলকাতার দূরত্বের প্রায় ৩ গুণ বেশি।
ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র বাগদাদে গিয়ে যেসব শিক্ষকের অধীনে পড়াশোনা করেন, তারা হলেন:
আবুল কাসিম হিবাতুল্লাহ রাহিমাহুল্লাহ
আবুল কাসিম যাহির রাহিমাহুল্লাহ
আবু গালিব আহমদ রাহিমাহুল্লাহ। [আকরাম নদভী, আল-মুহাদ্দিসাত, পৃষ্ঠা ৯৫]
তখনকার সময়ের একজন শিক্ষক বর্তমান সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডিপার্টমেন্টের সমতুল্য। একজন শিক্ষকের কাছে গিয়ে পড়াশোনা করার মানে হলো একটি বিষয়ে বা একটি কিতাব ঐ শিক্ষকের অধীনে সম্পন্ন করা; বর্তমান সময়ের একটি ডিগ্রি সম্পন্ন করার মতো।
যেহেতু ফাতিমা বিনতে সা’দের বাবা সা’দ আল-খায়র নিজে একজন আলেম ছিলেন, মেয়েকে কার কাছে পড়তে দিলে সে ভালো জ্ঞানার্জন করতে পারবে সেটা তিনি খুব ভালো করে জানতেন। ফলে, প্রাথমিকদিকে মেয়ের জ্ঞানার্জনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি।
সা’দ আল খায়েরের অনেক ছাত্র ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন যাইনুদ্দীন আবুল হাসান। ছাত্রের প্রতিভায় শিক্ষক মুগ্ধ হোন। এমন একজন জ্ঞানী ছাত্রের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দেন। [আকরাম নদভী, আল-মুহাদ্দিসাত, পৃষ্ঠা ৯৫]
ফাতিমা বিনতে সা’দ আল খায়রের বয়স যখন ১৯ বছর, তখন তাঁর বাবা ইন্তেকাল করেন। বাবার ইন্তেকালের পর স্ত্রীকে সার্বিক সহযোগিতা করেন যাইনুদ্দীন আবুল হাসান। তিনি নিজে ছিলেন একজন জনপ্রিয় ওয়ায়েজ, সুলতুন নুরুদ্দীন জেংকির সেক্রেটারি, সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর প্রিয়ভাজন। [আকরাম নদভী, আল-মুহাদ্দিসাত, পৃষ্ঠা ৯৫]
বিয়ের পর ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র স্বামীর সাথে বাগদাদ থেকে প্রথমে সিরিয়ার দামেস্কে ও পরবর্তীতে কায়রোতে স্থায়ী হোন। তাঁর শিক্ষকতা ক্যারিয়ার মূলত এই দুই শহরব্যাপী ছিলো। বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় ফাতিমার অধীনে পড়াশোনা করার জন্য।
ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র মুসলিম সভ্যতার রাজধানীগুলো থেকে জ্ঞানার্জন করেন, জ্ঞান বিতরণ করেন। উমাইয়া খিলাফতের রাজধানী দামেস্ক, আব্বাসী খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ, আইয়ূবী-মামলুক সালতানাতের রাজধানী কায়রোতে তিনি বসবাস করেন।
ইমাম আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেন, ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র বাবা ও স্বামীর মাধ্যমে অনেক সম্পদের অধিকারী হোন। কিন্তু, সম্পদের মোহে পড়েননি। তিনি জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখেন।
বাবা ও স্বামীর সম্পদ ভোগ করে তিনি চাইলে প্রশাধনী ও রূপচর্চার পেছনে সময় কাটাতে। কিন্তু, তিনি হাদীস-ফিক্বহ শেখা ও শেখানোর পেছনে তাঁর সারাজীবন বিনিয়োগ করেন।
মিশরের কায়রোতে বসে ফাতিমা পাঠদান করতেন। দামেস্ক, হামাদান, মিসরের তেন্নিস, ফিলিস্তিনের নাবলুস থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে হাদীস পড়তে আসতেন। ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়রের কয়েকজন ছাত্র পরবর্তীতে বিখ্যাত আলেম হোন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন:
মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল রাহিমাহুল্লাহ
ইসমাইল ইবনে আযযুন রাহিমাহুল্লাহ
জিয়াউদ্দীন আল-মাকদিসী রাহিমাহুল্লাহ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল ওয়াহিদ রাহিমাহুল্লাহ
আবুল কাসিম ইবনে হুসাইন রাহিমাহুল্লাহ
আবু মুহাম্মদ ইসহাক ইবনে মুহাম্মদ রাহিমাহুল্লাহ
আবুল হাসান ইবনে আল-কাসিম রাহিমাহুল্লাহ [আকরাম নদভী, আল-মুহাদ্দিসাত, পৃষ্ঠা ৯৫-৯৬]
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করুন, একজন নারী আলেমা ভারতের দেওবন্দ, মিসরের আল-আজহার, সৌদি আরবের মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাদীস-ফিক্বহ-ইসলামিক স্টাডিজে পড়াশোনা করে পাকিস্তানে স্থায়ী হোন। বর্তমান সময়ের পৃথিবীর জ্ঞানের কেন্দ্রগুলো থেকে জ্ঞানার্জন করে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীসের প্রফেসর হোন। পৃথিবীর নানান প্রান্তের শিক্ষার্থী তার কাছে পড়াশোনা করতে আসছে।
ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র তৎকালীন যুগে যেসব অঞ্চল ভ্রমণ করেন, তার একটি রোডম্যাপ।
আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগে ফাতিমা বিনতে সা’দ আল-খায়র রাহিমাহাল্লাহর প্রেক্ষাপট অনেকটা উপরের উদাহরণের মতো ছিলো।
[মুসলিম ইতিহাসে মহীয়সী নারিদের জীবনের গল্প নিয়ে লেখা ‘পুণ্যবতী-২’ থেকে]