বিশ্ববিজয়ী হাফেযরা কেন বিশ্ববিখ্যাত আলিম হয় না
এটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি আবদার ও আর্জি! প্রশ্ন ও আবদারটি কেবল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই নয়, বিশ্বপ্রেক্ষাপটেও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় প্রতিবছর বিশ্বসেরা বহু হাফিয ছাত্র বেরিয়ে আসেন, কিন্তু পরবর্তী জীবনে তাদের ইলমী ও জ্ঞানগত অবস্থান কী, তা আমরা আর জানতে পারি না।
এ না পারার কারণ কি এটিই, এই ‘বিশ্ববিজয়ী’ হাফেযরা পরবর্তীতে ইলম, মেধা ও যোগ্যতার এমন কোনো স্বাক্ষর রাখতে পারেনি, যা তাকে আবার বিশ্বমঞ্চে উপবিষ্ট করবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে-
কেন এসব বিশ্ববিজয়ী হাফিয বিশ্ববিখ্যাত আলিম ও স্কলার হতে পারে না?
হিফযের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার দেড় যুগ পেরিয়ে গেল। এতে কয়েকশ’ মেধাবী হাফিযে কুরআন বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলোতে তাদেরকে সেভাবে দীপ্তি ছড়াতে দেখা যায় না। মেধা ও কৃতিত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয় না। পরবর্তী জীবনে এদের কাউকে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আলিম ও স্কলার হওয়ার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। (আমার জানা সীমিত)
কিন্তু কেন?
অথচ ওদের কাছে দেশ ও জাতির অনেক বড় আশা ও প্রত্যাশা। এরা ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখবে। বিশ্বসভায় কুরআনের শিক্ষা বিস্তারে এবং দীনী খেদমতে সবিশেষ ভুমিকা পালন করবে। জীবনের প্রভাতবেলায় দিগন্ত আলো করে উদিত সূর্যটি সারাটি দিন জগতজুড়ে আলোর বিচ্ছুরণ করবে; এটাই সবাই আশা করে। কিন্তু মধ্যআকাশে পৌঁছার আগেই মেঘের কোন ঘনঘটায় এ প্রদীপ্ত সুর্যটি হারিয়ে যায়। এমনটি ঘটে কেন?
সুধী পাঠক, আপনাদেরও নিশ্চয় এমন কৌতুহল জাগে এবং তার ব্যাখ্যা আপনাদেরও আছে। ইচ্ছা করলে আপনিও তা কমেন্ট বক্সে লিখতে পারেন। তবে তা যেন শালীনভাবে হয়। হয়তো এতে অনেকের উপকার হতে পারে। আমি আমার নিজস্ব কিছু অনুভূতি শেয়ার করছি।
Table of Contents
এক
শিক্ষাজীবনের যে স্তরে এসে এ সব সম্মানিত হাফিযে কুরআনগণ প্রশংসা, পুরস্কার ও খ্যাতি লাভ করে থাকেন, তাতে তাদের চিন্তাধারা অনেকখানি বদলে যায়। বদলে যায় তাদের জীবনের গতিপথ ও গন্তব্য। তারা পথকে গন্তব্য ভেবে বসে পড়ে, আর গন্তব্যকে গৌণ ভেবে বিমুখ হয়ে পড়ে। তারা সামান্য খ্যাতি ও বৈষয়িক নগদপ্রাপ্তিকে ইলম সাধনার শেষ মনযিল মনে করে এবং সামনে চলাকে অপ্রয়োজনীয় ও পণ্ডশ্রম মনে করে। কারণ, সামনে ‘বিশ্বজয়ী’ হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার এরূপ কোনো প্লাটফর্ম নেই।
শিক্ষাজীবনের একেবারে প্রাথমিক স্তরে এসে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার এটি এক মারাত্মক ক্ষতি যে, বিজয়ীরা এটাকে পড়ালেখার শেষ মনে করে। অথচ সেটি ছিল মাত্র শুরু। ইলমের আসল মজা অনেক দূরে এবং মগজ অনেক গভীরে। মনে রাখতে হবে, ইলমের ব্যাপারে আত্মতুষ্টি ইলমের জন্য বড় বিপদ। এখানে ‘মানহুম গায়রে শাবে’ ও ‘তালিব’ হওয়া জরুরি।
দুই
অল্প বয়সে হাফিযে কুরআন হওয়া অতঃপর দেশেবিদেশে প্রকাশ্য প্রশংসিত হওয়া তাদের উচ্ছন্নে যাওয়ার অন্যতম কারণ মনে হয়। হাদীসে সমনাসামনি ও প্রকাশ্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। অথচ প্রশংসার বন্যায় তাদেরকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখের ওপর প্রশংসা করাকে ছুরি বিহীন যবেহ করার সাথে তুলনা করেছেন। তার মানে বড় বড় মঞ্চে ঘরে-বাইরে অতি প্রসংশা করে তাকে যবেহ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তার তালিবে ইলম ও ছাত্রসত্ত্বা মরে গেছে। বেঁচে আছে কেবল বিজয়ের মিথ্যা অহংকার। ছাত্রদের জন্য অতিপ্রশংসা ও পুরস্কার এবং অতি ভর্ৎসনা ও তিরস্কার উভয়টিই ক্ষতিকর।
তিন
‘উজব’ বা আত্মমুগ্ধতা নির্বুদ্ধিতার অন্যতম কারণ। এটি সুস্থবিবেকের জন্য মারাত্মক বিপদ। এটি সামাল দেওয়া কামিল পুরুষের জন্যও কঠিন। অথচ এসব বিজয়ী ছেলেরা প্রশংসা পুরস্কার পেয়ে চরম আত্মমুগ্ধতার ভোগে। ইউটিউব ফেসবুক মিডিয়ায় এসব সংরক্ষণ ও প্রদর্শন তাদের এ রোগকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বারবার এগুলো দেখা তার আত্মমুগ্ধতা ও আত্মহংকারকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। তারা নিজেদের দোষাত্রুটি দেখা ও আত্মবিশ্লেষণ করার সুযোগই পায় না। এ আত্মমুগ্ধতা ও আত্মশ্লাঘা তার মেধা ও বুদ্ধিকে ভোতা ও অকেজো করে দেয়। যদ্দরুণ কিতাবের গভীরে পৌঁছা এবং কুরআনের তত্ত্ব উপলব্ধি করা তার কাছে সুকঠিন মনে হয়। তখন নিজেকে সে কেবল লফয কুরআনের স্থুলতায় আবদ্ধ রাখতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করে।
চার
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- العين حق. “বদনজর বাস্তব।”
মানুষের বদনজরে যেকোনো দুর্ঘটনা, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। এরা হাজার লাখো মানুষের নজরে পড়ে। এর মাঝে দু’চারটি কুনজর থাকা অস্বাভাবিক নয়। এমনিতেই মানুষের সাধারণ নজর হজম করা এবং দৃষ্টিসহন ক্ষমতা খুব কম মানুষের থাকে। শিশু ও অল্পবয়সীদের এ সহন ক্ষমতা আরও বেশি দুর্বল থাকে। এজন্য বাচ্চাদেরকে জনসম্মুখে কম আনাই শ্রেয়। নজরকাড়া অল্পবয়সী এসব হাফেযরা মানুষের নজর এড়িয়ে বড় হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
পাঁচ
যেকোনো জিনিসের প্রাথমিক অবস্থা গোপন ও আড়াল থাকা বাঞ্চনীয়। পরিণত হওয়ার পূর্বে তা জনসম্মুখে না আসা চাই। বীজ দীর্ঘসময় মাটিতে লুকিয়ে থাকা এবং নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার পর বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়। মানবভ্রূণ দীর্ঘ সময় আড়াল থাকার পরে মানবসন্তান হিসাবে আত্মপ্রকাশ লাভ করে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম ও বিধান।
শিক্ষাজীবনের পুরোটাই গোপন থাকার সময়। নিজেকে আড়াল করার কাল। এটা তার তারবিয়াতের অংশ। উন্নত শিক্ষিতজীবন গড়তে চাইলে এটি অপরিহার্য। ব্যাপারটা যখন এমন, সেখানে একেবারে প্রাথমিক স্তরেই একজন শিক্ষার্থীকে বাজারে তোলা, আবার তাও বিশ্ববাজারে, তার মানসচিন্তায় মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষকরে যখন সে কারও তারবিয়াতের অধীন থাকে না।
ছয়
إنما الأعمال بالنيات ‘নিয়তের মান বরকত’ এটি হাদীসের কথা।
ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের বুনিয়াদে শুরু হওয়া হিফয ও ইলমের মেহনতে এ পর্যায়ে এসে নিয়ত খারাপের বেবরকত প্রবেশ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, পুরস্কারের নামে তাদের হাতে তখন বেশ কিছু দুনিয়া আসে, যা তার জন্য ফিতনার কারণ হতে পারে। যা তার ও তার অভিভাবকের ইখলাস ও একনিষ্ঠতাকে নষ্ট করে দিতে পারে।
সাত
“খ্যাতির বিড়ম্বনা” বলে একটি কথা আছে। এসব খ্যাতিমান হাফেযেরা জীবনের শুরুতেই সে বিড়ম্বনার শিকার হন, যা নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সামর্থ্য তাদের থাকে না। ফলে তারা পড়ালেখার মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ে।
আট
বিশ্বজয়ের রঙ্গীন স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে এত পরিশ্রম করানো হয় যে, তারা ক্লান্ত শ্রান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়ে। তারা আগামীতে অনুরূপ মেহনত করার ইচ্ছা, সাহস ও হিম্মত হারিয়ে ফেলে।
নয়
মেধাবী ও খ্যাতিমানদের বন্ধু হয় বেশি। সবাই তাকে কাছে পেতে চায়। এতে করে তারাও বন্ধুপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারও কারও বেলায় অনৈতিক বন্ধুত্বের অভিযোগও শোনা গেছে। উঠতি বয়সে এবং পড়ালেখার প্রাথমিকে বন্ধুর আধিক্য তাদের বড়ধরনের ক্ষতির কারণ হয়। অথচ সময়টা সস্পূর্ণ বইপ্রিয়তা ও পড়াপ্রেমের বয়স।
দশ
জাতীয় পর্যায়ে কোনো কোনো বিজয়ীর বিজয়ের পক্ষে লবিং, অনৈতিক লেনদেন এবং বিচারকদের পক্ষাপাতিত্ব ইত্যাদির অভিযোগ রয়েছে। (এ পোস্ট লেখাকালীনও একটি মাদরাসার দায়িত্বশীল এ অভিযোগ করেছেন।) যদি অভিযোগ সত্যি হয়ে থাকে; তাহলে এ বিজয়ের বিশেষ মাহাত্ম্য নেই। অন্যের হক নষ্ট করে অর্জিত বিজয়ে বরকতের আশা করা বোকামী। এমন বিজয়ীর আগামী সুখকর না হলে অন্যকে দোষারোপ করা দোষনীয়।
মোটা মোটি দশটি বিষয় মনে এসেছে। এগুলোতে একমত হতেও পারেন, আবার নাও হতে পারেন। সম্মানিত হাফিযে কুরআনের প্রতি পূর্ণ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখেই কথাগুলো লেখা হয়েছে।
বিশ্বাস করুন, আমার ইচ্ছা করে, নিজের মাথার চুল দিয়ে হাফিযে কুরআনের পা মুছে দেই। তারা তো সত্যি এমনই। আলহামদুলিল্লাহ, আমার দুই কলিজার টু্করাও হাফিযে কুরআন। নিজে হাফিয হওয়া স্বপ্ন এখনও লালন করছি। নিজেকে কুরআনুল কারীমের মুআল্লিম খাদিম ভাবতে পছন্দ করি। হাফিযে কুরআনকে অসম্মান করে নিজেকে ছোট করতে চাই না। উপরের কথাগুলোকে অভিযোগ হিসাবে নয়, আবদার ও আর্জি হিসাবে গ্রহণ করলে খুশি হবো।
আমরা চাই, এসব দেশ-বিদেশ জয়ী হাফিযে কুরআনগণ বিশ্ববিখ্যাত আলিম হয়ে আত্মপ্রকাশ করুন। তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নির্মাণের প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ করুন।
করণীয়
সম্মানিত হাফিয তালিবে ইলম ও তাদের অভিভাবকদের খেদমতে বিনীত আবেদন, আপনাকে/আপনার সন্তানকে আদর্শ আলিমে দ্বীন হিসাবে গড়ে তুলতে চাইলে প্রথমেই এসব প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলুন। মাদরাসাওয়ালারা যতই অনুনয়-বিনয় করুক, আপনি সবিনয়ে তা এড়াতে চেষ্টা করুন। এতে করে আপনি উপরুক্ত সমস্যাগুলো অনেকখানি এড়াতে সক্ষম হবেন, ইনশাআল্লাহ।
কোনো কারণে যদি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেই ফেলেন, অতঃপর ফলাফল উজ্জ্বল হয়ে আসে; তা হলে তাকে যথাযথ তরবিয়তের ব্যবস্থা করুন। নিজে না-পারলে কোনো বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের হাতে সোপর্দ করুন; যিনি সব লাইনে তার তারবিয়ত করবেন এবং প্রতিযোগিতার বিরূপ প্রতিক্রিয়া অপসারণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তাকে দ্রুত মিডিয়া থেকে আড়ালে নিয়ে যান। তার আশপাশে যেন বন্ধু জমতে না পারে, সে দিকে লক্ষ রাখুন।
সামনাসামনি তার অতি প্রশংসা হতে বিরত থাকুন। আল্লাহরওয়াস্তে তাকে বিজয়ী করার জন্য অনৈতিক অপকৌশল গ্রহণে বিরত থাকুন। বেশি বেশি ইস্তিগফার ও দুআ করুন। ছাত্র হোন আর অভিভাবক হোন, বড়াই না করে বিনয়ী হোন। নবীজি সা. বলেছেন :
مَنْ تَوَاضَعَ لِلَّهِ رَفَعَهُ اللَّهُ وَمَنْ تَكَبَّرَ وَضَعَهُ اللَّهُ “.
“যে আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, তাকে তিনি উঁচু করেন। আর যে বড়াই করে, তাকে তিনি অপদস্ত করেন।”
আল্লাহ তাআলা আমাদের হাফিযে কুরআনদের ‘হামিলে কুরআন’ ‘আমিলে কুরআন’ ‘মুআল্লিমে কুরআন’ বানিয়ে দিন। তাদেরকে যেকোনো ফিতনা ও মন্দ থেকে রক্ষা করুন, আমীন!