বিরোধ মীমাংসায় এক যুবকের কান্ড
চিন্তিত মনে মামুন গ্রামের রাস্তার এক পাশে বসে সবুজ ঘাস নাঁড়তে নাঁড়তে কী যেনো ভাবছিলো। এমন সময় গ্রামের এক প্রবীণ মুরব্বি আব্দুল মজিদ যিনি একজন সালিশ ব্যক্তিত্ব, সমাজে যার অনেক নাম-ডাক ও প্রভাব রয়েছে তিনি মামুনের গায়ে হঠাৎ হাত দিলে সে আঁতকে উঠলো। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
কী ব্যাপার, মামুন! তোমাকে যে খুব চিন্তিত লাগছে!
–জ্বি চাচা! একটু চিন্তিতই আছি।
–তা কী নিয়ে চিন্তা করছো?
–চাচা, তাদের দুই ভাইয়ের বিরোধ অমীমাংসিত থেকে যাওয়ায় মনটা খুব খারাপ। গতো কালকের সালিশিতে আপনারা তাদের বিষয়টি মীমাংসা করে দিতে পারলে আমার খুব ভালো লাগতো। চাচা, কেনো জানি আমার মনে হচ্ছে, তারা ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। তাদেরকে নিয়ে শুধু শুধু একের পর এক সালিশ হতেই চলছে।
–ও আচ্ছা!তুমি মাজেদ-সাজিদ দুই ভাইয়ের বিরোধের কথা বলছো। এতে তোমার চিন্তার কী হলো? এরা তো তোমার আপনও কেউ নয় আবার বংশেরও কেউ নয়।
–চাচা,কারো বিরোধ মিটানোর জন্য আপন হতে হবে কিংবা বংশের কেউ হতে হবে এমন বিষয় পূর্ব শর্ত নয়।অন্যের কল্যাণ করার মানসিকতা থাকলেই যে কারোর-ই উপকারে এগিয়ে আসা যায়। আজকে যদি আপনি তাদের জায়গায় থাকতেন তবে কি আপনি চাইতেন না যে,কেউ এগিয়ে এসে আপনার সমস্যাকে মীমাংসা করে দিক!নিশ্চয়ই চাইতেন।কারণ কোনো মানুষই চায় না কারো সাথে তার কোনো বিরোধ থাকুক।
এভাবেই কথাগুলো বলছিল সত্যের পথে থাকা এবং মানুষের কল্যাণ নিয়ে ভাবা গ্রামের এক ন্যায়পরায়ণ যুবক মামুনুর রশিদ মামুন।সে কেবল-ই মাস্টার্স শেষ করেছে। দ্বীন চর্চায়ও পিছিয়ে নেই।ইদানীং গ্রাম্য সালিশিতেও নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছে।তার কথায় হকের কথাই প্রাধান্য পায়। এলাকার লোকজনের কাছেও সে ভদ্র হিসেবে পরিচিত।
যাইহোক, মামুনের এমন কথাগুলো শুনে মজিদ সাহেবের ভালো লাগে নি। তিনি বলেন, দেখো বাবা! এসব নিয়ে ভাবার বয়স তোমার এখনো হয়নি।তুমি এসব বুঝবে না।পড়াশোনাতে ছিলে পড়াশোনাতেই থাকো। শুধু শুধু নিজেকে এসবে জড়াতে যেয়ো না।
কিছুটা রাগান্বিত স্বরে মামুন বলল,কেনো চাচা!যা বুঝবো না বলে আপনার মনে হয় তা আপনি আমাকে বুঝালেই তো পারেন। আপনারাই যখন এতো বুঝেন তবে মাজেদ-সাজিদ ভাইদের দ্বন্দ্ব এত দীর্ঘায়িত হচ্ছে কেনো? কেনো বারবার সালিশি বসেও তাদের বিষয়টি শেষ হচ্ছে না?
আপনারা চাইলেই তো তাদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে পারেন। তাছাড়া, আপনি গ্রামের একজন প্রবীণ সালিশি ব্যক্তিত্ব। এ সমাজে আপনার কথার আলাদা গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে।ফলে আপনার সামান্য আন্তরিকতাই তাদের রক্তের বন্ধন আবারও ফিরে পেতে পারে।
চাচা, আপনাকে আমি আল্লাহর সেই আয়াত স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যেখানে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায় ও ইনসাফের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তা’য়ালা তার মাধ্যমে তোমাদের যা কিছু উপদেশ দেন তা সত্যি সত্যিই সুন্দর! আল্লাহ তা’য়ালা সবকিছু দেখেন এবং শোনেন। [সূরা আন নেসা: ৫৮]
আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,‘যখন কোনো (বিবাদমান) বিষয়ে তোমাদের কোনো কিছু বলতে কিংবা মীমাংসা করতে হয়, তখন ন্যায়বিচার করবে যদিও (বিবাদমান পক্ষ) তোমাদের কোনো নিকটাত্মীয় হয়।’ [সূরা আল আনয়াম: ১৫২]
আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,
হে ঈমানদারগণ,তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকো; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান করো,তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনেরও যদি ক্ষতি হয় তবুও (তোমরা তা পালন করো)।কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে তাদের চাইতে আল্লাহ তা’য়ালার অধিকার অনেক বেশি। অতএব তোমরা কখনো ন্যায়বিচার করতে গিয়ে নিজের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে (জেনে রেখো) তোমরা যা কিছু করো না কেনো আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই খবর রাখেন।
[সূরা আন নেসা: ১৩৫]
আল্লাহ তা’য়ালা আরও বলেছেন,
মুমিনদের দু’দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও; অতঃপর তাদের একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে, যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করো, যতোক্ষন না তারা আল্লাহ্র নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি তারা ফিরে আসে, তবে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে আপোষ মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা ন্যায়বিচারকদেরকে ভালোবাসেন।
[সূরা আল হুজুরাত: ০৯]
এখন, যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা কারো মধ্যে থাকা বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য এতোবার বলেছেন সেখানে তাদের দুই ভাইয়ের বিরোধ মীমাংসা করে দিতে কিসের এতো বিলম্ব?
আর আপনারা কি চাইবেন না, ন্যায়বিচারকের ভূমিকা পালন করে আল্লাহর ভালোবাসা পেতে?
অন্যদিকে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,‘আমি কি তোমাদেরকে নামাজ, রোজা ও সদকার চেয়েও উত্তম কাজ সম্পর্কে বলবো না? সাহাবীগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, ‘বিবাদকারীদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করা। কারণ দুজনের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করা মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়’।
[জামে আত তিরমিযী, ২৫০৯; সুনানে আবু দাউদ, ৪৯১৯]
চিন্তা করেছেন, চাচা! কারো বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়া যদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ নাই-বা হতো তবে কি আর রাসূল (সাঃ) নামাজ,রোজার মতো ফরজ বিষয়ের চেয়েও উত্তম বলে আখ্যায়িত করতেন? বিষয়টি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হলে রাসূল (সাঃ) এভাবে বলতে পারেন তা কি আপনি ভেবে দেখেছেন? এরপরও কি আপনারা তাদের বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন না, চাচা?
কিন্তু মজিদ সাহেবের এসব শুনাতে আগ্রহ ছিল না। তা সত্বেও তিনি শুনে গেলেন। মনে হচ্ছিল বেশ কষ্ট করেই কথাগুলো শুনছিলেন। এক পর্যায়ে অনেকটা ধৈর্য্যহারা হয়ে তিনি বলে উঠলেন, বাবা! আর বলতে হবে না। এসব আমরাও জানি। আমরা কি আর কোরআন হাদীস কম পড়ি নাকি!
এদিকে তাদের এসব কথাবার্তার মাঝখানে ইতোমধ্যে গ্রামের আরেক সালিশ ব্যক্তিত্ব জমির আলী উপস্থিত হয়ে তাদের কথাগুলো শুনছিলেন। তিনিও মজিদ সাহেবের কথার সাথে সুর মিলিয়ে মামুনকে বললেন, হ্যাঁ বাবা! এসব বিষয়ে তোমাকে আর বলতে হবে না। আমরাও এসব জানি। আর শোনো, তুমি নিজেকে ওদের দ্বন্দ্বে জড়াইও না তো।ওদের ব্যাপারটা আমরাই দেখবো।
অতঃপর মামুনের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, এরা একটি ভিলেজ পলিটিক্স খেলে মাজেদ- সাজিদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিচ্ছে না। বরং তারা ভাইদের মধ্যে আরও দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে যা ইতোমধ্যে সে বেশ কয়েকটি সালিশের বিচার কার্যক্রম দেখেও আঁচ করতে পেরেছে।
মজিদ এবং জমির সাহেব মামুনের সাথে না পেরে অনেকটা রাগান্বিত ভাব নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলেন। তারাও বুঝতে পারলো, মামুন তাদের বিচার কার্যক্রম তীক্ষ্ণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই তো সে তাদের তালবাহানাপূর্ণ বিচারিক কার্যক্রমের দিকে আঙ্গুল তুলে নিজের ক্ষোভ থেকে কথাগুলো বলল।
এরপর মামুন গ্রামের আরও বেশ কয়েকজন সালিশি ব্যক্তিত্বের সাথে কথা বলেও খুব একটা আশার আলো দেখতে পায় নি। বেশীরভাগ মানুষই বলেন, অন্যের বিবাদের বিষয়ে আমরা জড়াতে চাই না। বরং বিষয়টি নিয়ে অমুক তমুক সালিশির নিকট যেতে বলেন। অর্থাৎ কেউ-ই এই বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে চান না। সবাই নিজের গা ঢেকে রাখতে পারলেই যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
পরের দিন মামুনের সাথে গ্রামের আরেক যুবকের দেখা হলো। তার নাম রকি। সে মামুনের সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো। সেও মামুনের মতো চায় মাজেদ-সাজিদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে কিন্ত প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সমাজের লোকদেরকে এ ব্যাপারে কিছু বললেও তার কথা তেমন গুরুত্ব পায় না। সেও বুঝতে পারলো কোনো মানুষের দ্বন্দ্ব মিটাতে মানুষের এগিয়ে আসাতে আগ্রহ খুবই কম। অথচ মানুষ নিজে বিপদে পড়লে অন্যের সাহায্য ঠিকই কামনা করে কিন্তু অন্যের বিপদে নিজেরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে চায় না। বিষয়টি তার কাছে অদ্ভুত মনে হলো।
যাইহোক, তাদের দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের অনীহা এবং সালিশি ব্যক্তিত্ব যাদের কাছ থেকে মীমাংসা করে দেওয়ার আশা করা হয়েছিল তাদের তালবাহানা দেখে মামুন নিজেই তাদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে উদ্যেগী হয়ে উঠলো।সে চিন্তা করলো,কিভাবে তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি মায়া-মহব্বত সৃষ্টি করা যায়। কেননা কোনো মানুষের অন্তরে আরেকজনের প্রতি মায়া-মহব্বত সৃষ্টি হলে সে মানুষের প্রতি দ্বন্দ্ব থাকে না।আর দ্বন্দ্ব থাকলেও তা মায়া মহব্বতের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিটতে শুরু হয়। তখন আর কাউকে এগিয়ে এসে তা মিটিয়ে দিতে হয় না।
যেই চিন্তা সেই কাজ। একদিন জুময়ার নামাজ শেষ করে বাড়ি যাওয়ার পথে মাজেদের সাথে মামুনের দেখা হয়ে গেলো। মামুন সুন্দর করে সালাম দিয়ে মাজেদকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে নিলো। প্রসঙ্গত, মামুন বাড়ির সহজ পথ দিয়ে না এসে কিছুটা ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে আসতে চাইলো যেনো কথা বলার জন্য কিছুটা বেশি সময় পাওয়া যায়।তাতে মাজেদেরও আপত্তি ছিল না। আর সামান্য কিছু দূর হাঁটতেই পেছন থেকে এসে সালাম দিয়ে রকিও তাদের সাথে যোগ দিলো। তারপর তারা একসাথে হাঁটতে হাঁটতে মামুন বলল,
–মাজেদ ভাই! আপনার সাথে কিছু কথা আছে! আপনি কিছু মনে না করলে কথাগুলো বলতাম, ভাই।
–কী কথা, মামুন? তুমি বলতে পারো।
–তবে আপনাকে আগে কথা দিতে হবে যে, আপনি এগুলো কাউকে বলবেন না।
–ঠিক আছে, আমি কাউকেই বলবো না।
–মাজেদ ভাই, আপনার বড়ো ভাই সাজিদ ভাই আপনার সম্পর্কে যা বললেন তাতে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি।
–কিছুটা উত্তেজিত কন্ঠে মাজেদ জিজ্ঞেস করলো, তিনি আবার নতুন করে আমার সম্পর্কে কী বলেছেন?
–ভাই, উত্তেজিত হবেন না। আমার কথাগুলো আগে শুনুন। সাজিদ ভাইয়ের মুখে আপনার প্রশংসা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। কারণ এমন দ্বন্দ্বে শত্রুকে কেউ প্রশংসা করতে পারে তা অন্তত আমার জানা ছিল না। ভাই,বিশ্বাস করুন, তিনি প্রায়ই আপনার খোঁজখবর নিতে আমার কাছে আসেন। এই যে গতো সপ্তাহে আপনার জ্বর হলো না তখনও কিন্তু তিনি আমার কাছে আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আপনি ঠিকমতো ডাক্তার দেখাচ্ছেন কিনা সেটির খবর নিয়ে উনাকে জানানোর জন্যও আমাকে বলেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি! আপন সম্পর্ক আপনই। তাতে যতোই দ্বন্দ্ব থাকুক না কেনো আপন রক্তের টান থাকবেই। তা না হলে কী আর তিনি শত্রু হয়েও ওভাবে জিজ্ঞেস করতেন না কি!
–কিন্তু তিনি তো সরাসরি আমার কাছে এসে খবর নিতে পারতেন!
–দেখুন মাজেদ ভাই, যখন কারো মাঝে দ্বন্দ্ব থাকে তখন আসলে একজন আরেকজনের খোঁজখবর নিতে ইতস্তত বোধ করেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা সরাসরি এসে জিজ্ঞেস করা হয় না। সেজন্য পরস্পরের মধ্যে মিল-মহব্বত থাকা প্রয়োজন, প্রয়োজন দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলা। তাই বলছিলাম কি! মাজেদ ভাই, আপনি যদি এসব দ্বন্দ্ব ভুলে ভাইয়ে-ভাইয়ের সম্পর্কে আবার ফিরে যেতেন।
–দেখো, মামুন! আমাদের রক্তের সম্পর্কে তো আমিও ফিরে যেতে চাই কিন্তু উনি আমার বড়ো ভাই হয়েও আমার বাবার সম্পত্তি থেকে আমার পাওনার পুরো অংশ দিচ্ছেন না কেনো! তাছাড়া, বড়ো ভাই হিসেবে এই দ্বন্দ্ব মিটানোর জন্য উনারই কি প্রথমে এগিয়ে আসা উচিত নয়?
–মাজেদ ভাই, দেখুন! যখন ভাইয়ে ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো অবস্থানে না থাকে তখন সহায়-সম্পত্তি ইত্যাদি নিয়ে ঝামেলা থাকবেই। এগুলোর জন্য সরাসরি ভাইয়ের সাথে শান্ত পরিবেশে কথা বলা দরকার। তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ দিলে চলবে না। আর উত্তেজিত মন নিয়ে কথা বললে এসব অমীমাংসিত থেকে যাবে, ভাই। তাছাড়া, গ্রামের দুষ্ট লোকের দুষ্টুমি তো রয়েছেই। এরা এমন সুযোগে সমাধানের পথ না খুঁজে বরং তামাশা করে, উপভোগ করে।
সালিশি কার্যক্রমকে ইচ্ছে করেই দীর্ঘায়িত করে তুলে। আর এক পক্ষকে আরেক পক্ষের কথা লাগিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কিভাবে দ্বন্দ্ব আরও বাড়িয়ে দেওয়া যায় সেই পথেই হাঁটতে থাকে। কাজেই আগে আপনাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।আর নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক থাকলে এগুলো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। ইন শা আল্লাহ!
এছাড়া, আপনি বলছিলেন যে, বড়ো ভাই হিসেবে তিনিও তো দ্বন্দ্ব মিটাতে প্রথমেই এগিয়ে আসতে পারতেন। আসলে, উনার কথাতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, উনি এই দ্বন্দ্ব মিটাতে কতোটা আন্তরিক। আন্তরিক না হলে কি আর আপনার খবর পর্যন্ত নিতেন? কিন্তু তবুও তিনি আসতে পারছেন না।
আসলে, সবকিছুর পর উনি আপনার বড়ো ভাই। তাই অনেক দিন ধরে দ্বন্দ্বে থাকা ছোট ভাইয়ের সাথে এসে কথা বলতে তো একটু ইতস্ততা বোধ থাকবেই। কাজেই ছোট ভাই হিসেবে আপনি যদি এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতেন তবে ব্যাপারটা অনেক সুন্দর দেখায়।আর আমি তো আপনার সাথেই আছি।
উত্তেজিত কন্ঠে কথা বলা শুরু করা সেই মাজেদের অন্তরটা যেনো এবার সিক্ত হতে শুরু হয়েছে। যেনো আপন সম্পর্কের টান অনুধাবন করতে পারছে, বুঝতে পারছে তাদের ভাইদেরকে নিয়ে এতো দিন ধরে খেলা গ্রাম্য সালিশি ব্যক্তিত্বের ভিলেজ পলিটিক্স। আরও বুঝতে পারছে এসব মিটিয়ে ফেলার গুরুত্ব। এছাড়া, মনে মনে ভাবলো, যে ভাই আমার শত্রু হওয়া সত্ত্বেও আমার খোঁজ খবর নিতে পারেন, প্রশংসা করতে পারেন সে ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্ব রাখা যায় না। তাই আর দেরি না করে কবে বড়ো ভাইয়ের সাথে এসব দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সাক্ষাৎ করা যায় সেই দিন-তারিখটাই মামুনের কাছে জানতে চাইলো।
কিন্তু মামুনের যে আরও কাজ বাকি রয়ে গেছে। তাই সে এখনি তারিখ দিতে পারলো না। বরং পরবর্তীতে জানাবে বলে অপেক্ষায় রেখে আসলো। একইসাথে, কথা শুরু করার আগের প্রমিজটাও মনে করিয়ে দিয়ে আসলো।
এতোক্ষণ তাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে থাকা রকি মামুনের প্রশংসা করে বলল, ওয়েল ডান, ভাই! আপনি খুব সুন্দর করে তাদের দুই ভাইয়ের সম্পর্ক জোড়া লাগানোর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে ভাই, আমার মন একটি প্রশ্নের উওর পাওয়ার জন্য খুব অস্থির হয়ে আছে।
–কী। তোমার প্রশ্ন,বলো?
–এই যে, ভাই! আপনি সাজিদ ভাই সম্পর্কে মাজেদ ভাইকে যা যা বলেছেন তা কি সত্যি সত্যিই সাজিদ ভাই আপনাকে বলেছিলেন?
–রকি, তুমি আগে প্রমিজ করো যে, কাউকেই কথাটি বলবে না?
–প্রমিজ করলাম ভাই, কাউকেই বলবো না।
–তাহলে শোনো, সাজিদ ভাই সম্পর্কে মাজেদ ভাইকে বলা একটি কথাও সত্য ছিল না। তবে মাজেদ ভাইয়ের কেবল অসুস্থের কথা আমি আগে থেকেই জানতাম। সেটাই এখানে কাজে লাগিয়েছি।
–বিস্মিত চেহারায় রকি জিজ্ঞেস করলো, ভাই আপনি একজন সৎ মানুষ হয়েও এতো বড়ো দ্বন্দ্বের বিষয়ে এতো বড়ো মিথ্যা কথা বলতে পারলেন কিভাবে? ভাই,আপনি কি জানেন না মিথ্যা বলা কবিরা গোনাহ, মহাপাপ?
–দেখো রকি, প্রথম কথা হচ্ছে, পবিত্র কোরআন মাজীদে মহান আল্লাহ ত’য়ালা বলেছেন যে,
‘নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করে দাও।আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা দয়া প্রাপ্ত হও।’ [সূরা আল হুজুরাত: ১০]
এই আয়াতের আলোকে একজন মুসলিম হিসেবে কারো মধ্যে লেগে থাকা কোনো বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়া আমার দায়িত্ব। তাছাড়া, কারো বিবাদ মীমাংসায় এগিয়ে আসলে আল্লাহই দয়া তথা সাহায্য করবেন বলে ঐ আয়াতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আবার,রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
‘মুসলিম সকলে মিলে একটি দেহের মতো, যার চোখে ব্যথা হলে গোটা দেহের কষ্ট হয়। মাথা ব্যথা হলে গোটা দেহের ব্যথা হয়।’
[সহীহ মুসলিম : ২৫৮৬]
ফলে আমার জানাশোনা কোনো মুসলিম ভাই দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকবে আর আমি সেটার ব্যাথা অনুভব করবো না এবং তাদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো না তবে আমি কেমন মুসলিম? এটা সম্পূর্ণত মুসলিমসুলভ আচরণের বিরোধী।
অপরদিকে আমি জানি যে, মিথ্যা বলা মারাত্নক কবিরা গোনাহ। কিন্তু রকি, তিনটি স্থানে মিথ্যা বলা জায়েজ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে কারো দ্বন্দ্ব মিটানোর ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা যায়। আর আমি তো কেবল তাদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে এমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি যা ইসলাম সমর্থন করে।
[আবু দাঊদ হা/৪৯২১; সহীহ মুসলিম, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০৩১ ও ৫০৩৩ ]
–তাই না কি ভাই? এরকম ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েজ রয়েছে তা তো আমি আগে জানতাম না। অন্যথায়, আমিও এভাবে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্বগুলো মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম।
–তাহলে তো ভালোই হলো! নতুন করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোমার জানা হয়ে গেলো যা এখন থেকে কোনো বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে তুমি কাজে লাগাতে পারবে।
–জ্বি ভাই! আচ্ছা মামুন ভাই, তাদের দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব অনেক বছর ধরেই চলছে। যতোদূর জানি, তাদের মধ্যে এখন দা-কুমড়া সম্পর্ক। তাই আপনার এভাবে বলাতেও কি তাদের দ্বন্দ্বের অবসান হবে?
–দেখো রকি, তাদের দ্বন্দ্বের অবসান হবে কিনা মহান রাব্বুল আলামিনই ভালো জানেন। আল্লাহর বলা অনুযায়ী আমার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের বিরোধ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করে যাওয়া, এতোকিছু চিন্তা করা নয়। কারো দ্বন্দ্ব মেটাতে এগিয়ে আসলে আল্লাহ রহমত দিবেন সেটা তো আগেই বলে রেখেছেন। তাই এতো চিন্তা কিসের?
আর এক্ষেত্রে কে এগিয়ে আসলো বা না আসলো তাও আমার দেখার বিষয় নয় বরং আমার দেখার বিষয় হচ্ছে আমি আমার নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে গেলাম কিনা।আর আমি চাই আমার স্থান থেকে যেনো তাদের ব্যাপারে কোনো ত্রুটি না থাকে। এছাড়া,শুরুতেই আমি এমন মানসিকতা রাখতে চাই না যে, তাদের বিরোধের মীমাংসা হবে না কিংবা অসম্ভব কিছু। বরং আমি আমার জায়গা থেকে যতোটুকু সম্ভব ততোটুকুই করে যেতে চাই। এক ভাই তার আরেক আপন ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকবে আর আমি একজন মুসলিম প্রতিবেশী হয়ে মাসের পর মাস নীরব দর্শকের ভূমিকায় থেকে কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে যাবো তা কক্ষণোই হতে পারে না। এটা কোনো ঈমানদারের কাজ নয়।
মামুনের এমন সুন্দর মানসিকতা দেখে রকি কী বলবে যেনো সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। কেবল এতোটুকুই বলল, ভাই! আপনার কথা যতো শুনি ততো মুগ্ধ হই। আপনার মতো মানুষ থাকলে কারো মধ্যে বিরোধ থাকবে না। সত্যিই আপনার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শিখার আছে, ভাই।
এদিকে এসব শুনাতে মামুনের মন ছিল না। কারণ মামুনের এখনও যে আরও অনেক কাজ বাকি। মামুন চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে মাজেদের বড়ো ভাইকে এখন কনভিন্স করানো যায়।
যাইহোক, পরদিন সকালে বাজারের চা স্টলে সাজিদের সাথে মামুনের দেখা হলো। দেখা হতেই মামুন সাজিদকে প্রতিবারের ন্যায় সুন্দর করে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো। প্রায় একইভাবেই সাজিদের সাথে কথা বলা শুরু করার চেষ্টা করলো। এদিকে সাজিদ মামুনের জন্য এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে রাখলো। তারপর মামুন বলল,
–সাজেদ ভাই, আপনার সাথে কিছু কথা আছে। তবে আপনাকে আগে কাউকে কথাগুলো না বলার প্রমিজ করতে হবে।
–প্রতিশ্রুতি দিলাম কাউকে বলবো না। তুৃমি নিঃসংকোচে বলতে পারো, মামুন।
–দেখুন সাজিদ ভাই, আপনি যতোই আপনার ভাইকে শত্রু মনে করেন না কেনো আপনার ভাই কিন্তু আদতে আপনার কোনো শত্রুুই নয়। কারণ কোনো শত্রুু হয়ে যাওয়া আপন ভাই তার আরেক আপন ভাইয়ের খবর নিতে পারে না, পারে না ছোট ভাইকে আগলে রাখার স্মৃতিগুলো স্মরণ করে বড়ো ভাইয়ের প্রশংসা করতে।
–কেনো? সে তো আমার শত্রুই! শুনলাম, সে নাকি আমার উপর মামলা করবে? সে নাকি ইতোমধ্যে মামলার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে।
–কী বলেন এসব! আপনাকে কে এসব বলেছে, সাজিদ ভাই?
–এই তো কেউ একজন বলেছে। তুমি আবার এসব কাউকে বলতে যেয়ো না। যিনি বলেছেন তিনি আমাকে কথাগুলো প্রকাশ না করার জন্য বারণ করেছেন!
–দেখুন, সাজিদ ভাই! এখানে আমাদের একটু বিবেক খাটানো উচিত। আচ্ছা! আপনার ভাই যদি মামলার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন বলে উনাকে বলেও থাকেন তারপরও কি তিনি এই কথা আপনাকে এসে বলতে পারেন? বিবেক কী বলে?তা হলে কি আমরা এটা বুঝতে পারি না যে, যিনি আপনাকে এমন কথা বলেছেন তিনি আসলে দ্বন্দ্বটি আরো লাগিয়ে রাখতে চাইছেন, দ্বন্দ্বের তীব্রতা আরো বাড়াতে চাচ্ছেন। তিনি আপনাদের দ্বন্দ্বের অবসান হোক সেটা চাইছেন না। তা না হলে তিনি কেনো আপনাকে এসে আপনার শত্রু পক্ষের এমন নেতিবাচক কথা বলবেন? উনার কি উচিত ছিল না যে, এমন কথা পরিহার করা যে কথায় সমাধান না হয়ে বরং আরও সংঘাতের দিকে যায়?
তাছাড়া, উনার কথাগুলো যদি সত্য হয়ে থাকে তবে আপনাকে ওগুলো না বলার জন্য বারণ করবেন কেনো! তা তো প্রকাশ্যেই বলা উচিত ছিল। এইগুলোই কি এটা বুঝার জন্য যথেষ্ট নয় যে, তার মতো লোকেরা গোপনে গোপনে আপনাদের দ্বন্দ্বের আগুনে পেট্রোল ঢালতে চাচ্ছে! মূলত, এমন তথাকথিত সালিশি ব্যক্তিত্বরাই আজকের সমাজের অধিকাংশ দ্বন্দ্বগুলোর মীমাংসা না হওয়ার জন্য দায়ী। এদের জন্যই আজকের সমাজের মানুষেরা প্রকৃত সালিশি ব্যক্তিত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। নিজেদের দ্বন্দ্ব মীমাংসিত না হওয়ায় সমাজের কতো মানুষজন যে মানুষের দ্বারে দ্বারে বড়ো অসহায়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে,কতো মানুষজন যে পেরেশানিতে ভুগছে তার কোনো হিসেব নেই।
মামুনের কথাগুলো শুনে সাজিদের বোধোদয় হলো যে, সত্যিই তো তিনি আমার ভাইয়ের এমন নেতিবাচক কথা আমার কাছে এসে কেনো বলবেন।এমন কথা তো আমাদের দ্বন্দ্ব মেটানোর কোনো ইঙ্গিত বহন করে না।তাহলে কি তিনি চান না যে,আমাদের ভাইদের দ্বন্দ্বের অবসান হোউক। তবে কি আমারও কোনো নেতিবাচক কথা আমার ভাইকে তিনি এভাবে বলে বেড়াচ্ছেন!এসব চিন্তা তার মাথায় আসতে লাগলো।
এক পর্যায়ে সাজিদ বুঝতে পারলো যে, তাদের দ্বন্দ্ব মীমাংসা না হওয়ার জন্য কিছু তথাকথিত সালিশি ব্যক্তিরাই দায়ী যাদের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। তাই সাজিদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, এইসব গ্রাম্য তথাকথিত সালিশিরাই গোপনে গোপনে তাদের বিরোধ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে গ্রাম্য বহু সালিশেও ভাইয়ের সাথে থাকা বিরোধের নিষ্পত্তি হচ্ছিল না, হচ্ছিল না ভাইয়ে-ভাইয়ে মিল। এসব চিন্তা করে বললো,
কিন্ত মামুন, আমি তো তার বড়ো ভাই। ছোট ভাই হিসেবে সেও তো আমার সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতো!
–দেখুন, সাজিদ ভাই! আপনি বড়ো ভাই তাই আপনার দায়িত্বও বড়ো। অনেক দিন ধরে আপনার সাথে সম্পর্ক না থাকার দরুন হঠাৎ করে এসে আপনার সাথে কথা বলতে ছোট ভাইয়ের তো একটু ইতস্ততা বোধ থাকবেই।তাই বলছিলাম কি! আপনি যদি বিষয়টার প্রতি আন্তরিক হয়ে এগিয়ে আসতেন তবে আপনাদের মধ্যে চলমান এই দ্বন্দ্বটি আর থাকবে না। ইন শা আল্লাহ!
আপনারা ভাইয়েরা যদি একে অপরের প্রতি মহব্বত রাখেন, মিলেমিশে থাকেন তবে আপনাদেরকে নিয়ে গ্রামের কোনো অসাধুরা কোনো গেইম খেলতে পারবে না, পারবে না আপনাদের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে কোনো সুবিধা নিতে কিংবা ভিলেজ পলিটিক্সে মেতে উঠতে।
সাজিদ ভাই, এই যে আপনাদের ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধ চলছে তাতে কি আপনারা কেউ শান্তিতে রয়েছেন? শান্তিতে নেই তো। এগুলো বরং আরও পেরেশানি বাড়িয়ে দেয়।তাই দু’দিনের দুনিয়াতে শুধু শুধু ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্ব রেখে কী লাভ! ভাই তো আপনারই, ভাইয়ের কোনো ক্ষতি হলে প্রকৃতপক্ষে আপনারই তো ক্ষতি হবে। তাই না? এগুলো একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আর ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্বে থাকা মানে নিজেরা পেরেশানিগ্রস্ত থেকে কিছু অসৎ লোককে আনন্দ করার সুযোগ করে দেওয়া।
কাজেই আপনাদের নিজেদের মধ্যে একতা থাকা, মিল মহব্বত থাকা খুবই জরুরি। আর বিশ্বাস করুন, আপনাদের মধ্যে হঠাৎ মিল দেখে সমাজের তথাকথিত সালিশি ব্যক্তিদের এবং আপনাদের দ্বন্দ্ব দেখে খুশি হওয়া মানুষগুলোর গালে একদম খশে থাপ্পড় দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। একইসাথে, আপনাদেরকে নিয়ে তামাশা করার, ভিলেজ পলেটিক্স করার আর কোনো সুযোগ তাদের থাকবে না।
সাজিদ একটু হেসে বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো, মামুন! আমাদের আকস্মিক মিল দেখে দুষ্টদের হজম করতে কষ্টই হবে। আসলে, এগুলো নিয়ে তো আগে চিন্তা করি নি তাই বুঝতেও পারি নি।
যাইহোক, আমাদের বিষয় নিয়ে তোমার আন্তরিকতা আমার চিরদিন মনে থাকবে। তোমার এ উপকারের কথা কোনোদিনই ভুলার নয়।আমি সত্যিই তোমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।
এদিকে তাদের কথার মাঝখানে মামুনের জন্য রেখে যাওয়া চা ঠান্ডা হতে দেখে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিলো সাজিদ। এবার চায়ের সঙ্গে বিস্কুটেরও অর্ডার দিলো যেনো মামুনের প্রতি খুবই খুশি হওয়ার বহিঃপ্রকাশ। মামুন চা খেতে না চাইলেও এক প্রকার জোর করেই খাওয়াতে চাইলো সাজিদ।
তারপর চা এনে দিলে মামুন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, দেখুন সাজিদ ভাই! আমি আসলে আপনার জন্য তেমন কিছুই করি নি। যা করেছি তা একজন মুসলিম হিসেবে আমার দায়িত্বটুকু পালন করার চেষ্টা করেছি মাত্র। সবই মহান আল্লাহ তা’য়ালাই করিয়েছেন। সমস্ত প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামিনের। আল্লাহ যদি আমাকে তাওফিক না দিতেন তবে আমি আপনার জন্য এতোটুকুই করতে পারতাম না। তাই আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। আলহামদুলিল্লাহ!
–মা শা আল্লাহ! সত্যিই তুমি অনেক সুন্দর করে কথা বলো, মামুন!
মামুন প্রশংসিত হয়ে ততোটা খুশি হয়নি যতোটা খুশি হয়েছে তাদের ভাইদের মধ্যে বিরোধ মিটাতে পেরে। আর এখন মামুন পুরোপুরিই চিন্তামুক্ত। কেননা সে দুই ভাইকেই মিল করাতে পারার শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছে গিয়েছে।
সাজিদ বলল, আচ্ছা, মামুন! এখন আমি কিভাবে এই বিষয়টিকে মীমাংসা করতে পারি?
–একদম সহজ! বড়ো ভাই হিসেবে আপনি ছোট ভাইকে দাওয়াত দিয়ে দিন। তাহলেই তো হয়! দেখবেন, আপনার ভাই কতো খুশি হয়ে আপনার বাসায় চলে আসেন। আর এভাবেই আপনাদের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের অবসান হবে। ইন শা আল্লাহ!
মামুনের পরামর্শে একদিন পরই সাজিদ তার ছোট ভাই মাজেদকে দাওয়াত খাওয়ানোর জন্য মামুনের মাধ্যমেই দাওয়াত পাঠালো। একইসাথে মামুনকেও দাওয়াত দিয়ে রাখলো।
মামুনের কাছ থেকে মাজেদ তার ভাইয়ের দাওয়াত পেয়ে খুশি মনে গ্রহণ করলো এবং ভাইয়ের দাওয়াতে আসার মনস্থির করলো।
অতঃপর দাওয়াতের দিন বড়ো ভাইয়ের বাড়িতে এসে মামুনের মতো এক সৎ যুবকের মধ্যস্থতায় দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বের অবসান হলো। ফিরে পেলো রক্তের বন্ধন।
এদিকে মাজেদ-সাজিদ ভাইদের সম্পর্ক পুনরায় ফিরে পাওয়ার দৃশ্য দেখে গ্রামের হিংসুক লোকদের চেয়ে চেয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকলো না। দুষ্টদের গালে যেন খসে অদৃশ্য এক চড় পড়েছে।
কিছু কথাঃ
দেখুন, আমাদের সমাজের ঘরে-বাইরে অনেক মানুষের মধ্যেই এরকম অনেক দ্বন্দ্ব লেগে আছে। আর সেগুলোর বেশীরভাগই আপন সম্পর্কের মধ্যে হয়ে থাকে। আমাদের সামান্য আন্তরিকতাই কারো সম্পর্ক আবার নতুন করে ফিরে পেতে পারে।তাই এরকম বিষয়ে সাত-পাঁচ না ভেবে মামুনের মতো আমাদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু খারাপ লোক রয়েছে যারা চায় না কারো দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে বরং কিভাবে দুই পক্ষের মধ্যে নানান মন্দ কথা বলে দ্বন্দ্ব আরও বাড়িয়ে দিয়ে ফায়দা লুটা যায় সেটাতেই ব্যস্ত থাকে। আর এদের থেকে বাঁচতে আমাদের মধ্যে একতা বজায় রাখতে হবে,দ্বন্দ্ব যাতে না হয় সেভাবে চলতে হবে।অন্যথায়, সুযোগ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা এমন খারাপ লোকদের একবার সুযোগ দিয়ে দিলে তারা সে সুযোগের সদ্বব্যবহার করেই ছাড়বে। সুতরাং সাবধান!
কারো মধ্যে বিরোধ থাকলে আমাদের উচিত সেই বিরোধ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেওয়া,উপভোগ করে যাওয়া নয়। আর কারো বিরোধ মিটানোর ক্ষেত্রে আমরা যেনো মামুনের মতো মানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারি। এছাড়া মামুনের মতো এভাবে সফল হতে পারবো কী পারবো না সেরকম কিছু শুরুতেই মাথায় এনে এমন বিষয়ে এগিয়ে আসাতে যেনো অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।