যে বন্ধু বয়ে আনে কল্যাণ
সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিকগণ বলে থাকেন- মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে থাকবার জন্য ই তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনকি এ মতটিও প্রচলিত রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সম্বোধন করতে গিয়ে বারংবার যে انسان (ইনসান) শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তার রুট হলো انس (উন্স)। যা দ্বারা বোঝানো হয়, সঙ্গ বা বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা।
‘ইনসান’ কে ‘ইনসান’ নামকরণের পেছনে যৌক্তিকতা হলো এই ই যে, ইনসান কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে একা বাস করতে পারে না।
বেঁচে থাকার জন্য তাঁর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, সাহচর্য প্রয়োজন। কেউ যদি সমাজ থেকে একেবারে দূরে চলে গিয়ে নির্বাসিত হতে চায়, একা একা জীবন কে উপভোগ করতে চায় আমরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন হিসেবে বিবেচনা করে থাকি।
চারপাশের সবকিছু নিয়ে ভাবলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ পরিলক্ষিত হয়। কিছু সম্পর্ক রয়েছে, যা আমাদের এখতিয়ার ভুক্ত নয়; যা আমরা নিজেরা বেছে নিতে পারি না।
যেমন- আমরা যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি তা বাছাই করবার কোন সুযোগ আমাদের ছিলো না। নিজেদের পিতামাতা, ভাইবোন; তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে মনমতো নির্বাচিত করা যায় না।
কিন্তু আমরা আবার আমাদের জীবনসঙ্গী কে বাছাই করবার এখতিয়ার রাখি। কেউ কেউ সমাজ দ্বারা আমাদের জন্য নির্বাচিত হন।
যেমন- কর্মক্ষেত্রে আমাদের সহকর্মীরা। তাদেরকে আমরা বেছে নিই না। আবার তাদের আমাদের উপর চাপিয়ে ও দেয়া হয় না। তবু, অপছন্দ হলেও তাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানিয়ে চলতে হয়। আমাদের যাত্রাপথে যারা পার্শ্ববর্তী আসনে বসেন, তাদের সাথে ও আমাদের সম্পর্কের হক্ব রয়েছে। কিন্তু এরা কেউ ই আমাদের নিজস্ব যাচাই বাছাই দ্বারা নির্বাচিত নন।
তবে, সামাজিক এ মিথস্ক্রিয়ার যে প্রক্রিয়া, এতে এমন একটি লেভেল রয়েছে, যা আমাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি, পছন্দ অপছন্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এবং সেই বিশেষ সেক্টরটি হলো- বন্ধু।
এমন একজন মানুষ, যার সাথে সামাজিক সম্পর্কের দিকগুলো মেইনটেইন করতে আমরা পছন্দ করছি, তাকে আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে আমার ভালো লাগছে, আমি তার বাড়িতে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি- তাকে বন্ধু বলে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
কোরআন এবং সুন্নাহ আমাদেরকে যোগ্য বন্ধু বাছাইকরণের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে নির্দেশ দিয়েছে।
আমরা এ শিক্ষা পাই যে, দ্বীনের একটি অন্যতম অংশ হলো- কিছু ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করে তার আলোকে বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করা।
রাসূল(সাঃ), একজন উত্তম, ধার্মিক বন্ধু থাকবার উপকারিতা কেমন হতে পারে এবং একইসাথে একজন অন্যায়কারী বন্ধু থাকা কতোটা বিপদজনক, ক্ষতিকর হতে পারে; তা আমাদের জানিয়েছেন।
এ নিয়ে অনেক বর্ণনা রয়েছে, তন্মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ সেই চমৎকার হাদীসটি হলোঃ
রাসূল(সাঃ) বলেন,
مَثَلُ الجليس الصالحُ والجليسُ السوءِ كحامِلِ المسك، ونافخِ الكِيْرِ
“সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হল আতরওয়ালা এবং হাঁপরে ফুঁকদানকারীর (কামারের) মত।
এরপর তিনি এর ব্যাখ্যা প্রদান করলেন,
আতরওয়ালা হয়ত তোমাকে কিছু দান করবে অথবা তুমি তার নিকট থেকে কিছু ক্রয় করবে অথবা তার নিকট থেকে তুমি এমনিতেই সুগন্ধি লাভ করবে। অপরপক্ষে কামারের ভাট্টি তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে অথবা তার থেকে তুমি দুর্গন্ধ লাভ করবে।”
(সাহীহুল বুখারী, হাদীস নম্বর-৫২১৪)।
প্রিয় নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই হাদীসটিতে উত্তমরূপে বোধগম্য ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, সৎ, পূন্যবান ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকলে তা কেবল কল্যাণময় প্রভাব ফেলতে পারে এবং মন্দ লোকেদের প্রভাব নিছক মন্দ ই বয়ে আনে।
আল্লাহর উত্তম বান্দাগণ তিন উপায়ে আপনার জন্য কল্যাণ বহন করবেন।
১। তাঁরা আপনাকে কোন আর্থিক লেনদেন ব্যতীত হাদিয়া প্রদান করবে। তা হতে পারে দৃশ্যমান কোন হাদিয়া। কেননা, রাসূল (সাঃ) মুমিন বান্দাদের এঁকে অপরকে হাদিয়া দিতে বলেছেন, কেননা এতে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। অথবা তা হতে পারে ইলম, বিচক্ষণতা লাভ, নিজের আত্মোন্নয়নের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া- যা নিঃসন্দেহে জাগতিক কোন হাদিয়া অপেক্ষা বহুগুনে মূল্যবান।
২। কিংবা এমন হতে পারে, আর্থিক লেনদেনের বদৌলতে তার ও আপনার মাঝে একটি সম্পর্ক তৈরি হলো। এবং অবশ্য ই, সৎ বান্দার সাথে আর্থিক বিনিময়ের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা সম্পর্ক বরকতপূর্ণ। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একজন পুণ্যবান বান্দার চাইতে অধিক বিশ্বস্ত আর কে হতে পারে!
ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব করবার সময় আমি একজন আল্লাহভীরু বান্দাকে পছন্দ করা উচিত। আমাকে সুগন্ধি ক্রয় করতে হবে, ব্যবসা করতে হবে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে ও আমি সবসময় খুঁজে বেড়াবো মুত্তাকী বান্দাদের। কেননা সততা কখনোই মূল্য দিয়ে কেনা যায় না। সততা আল্লাহর প্রতি ভয় থেকে উদ্ভূত হয়।
৩। আরেক রকম হতে পারে এরূপ যে- সে আমায় কিছু দিলো ও না, আমিও নাহয় কিছুই কিনলাম না। কিন্তু এ সৎ সঙ্গের ন্যুনতম লাভ হচ্ছে এই ই যে, তার সাহচর্য প্রশান্তি জাগায়, অন্তরকে সজীব করে, চক্ষু শীতল করা অনুভুতি জাগায় মনে।
তাহলে দেখুন, এক্ষেত্রে আপনার হারাবার কিছুই নেই।
অপরদিকে অসৎ সঙ্গ আপনার কি ক্ষতি করছে?
১। হয় সে আপনাকে তার সাথে ধ্বংসের পথে টেনে নেবে এবং আপনার সর্বনাশ করে ছাড়বে। তার পাপ দ্বারা আপনাকে পুড়িয়ে ভস্ম করবে।
২। যদি আপনি সেই পতনোন্মুখ পরিস্থিতির সম্মুখীন না ও হন, তার সান্নিধ্যে থাকা সময়টুকু কি কল্যাণ বয়ে আনতে পারে কোনভাবে? না। বরং তা এক বিচ্ছিরি, অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম দেয়। এটি এক প্রমাণিত সত্য।
আমাদের অনেকেই এটি ফেস করেছেন। অবাধে পাপ করা হচ্ছে এমন কোন একটি জায়গায় হুট করে উপস্থিত হবার পরের অনুভূতি ঠিক কেমন?
মাথায় তখন কেবল এ চিন্তা ই ঘুরপাক খেতে থাকে যে, কতোক্ষণে এ থেকে রেহাই পাবো, স্থানত্যাগ করবো। ঠিক যেমনটা রাসূল(সাঃ) বলে গিয়েছেন, যদি এ মন্দ তোমায় স্পর্শ করতে না ও পারে, এর প্রভাব তোমার মনের উপর পড়বে।
তাই, আমরা এমন লোকেদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করবো, যারা আমাদের দ্বীন এবং পাশাপাশি দুনিয়াবী জীবনে পথচলার জন্য উত্তম সঙ্গী হবে। এবং এ ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করে বন্ধু নির্বাচন, ইসলামী শরি’আহর অন্তর্ভুক্ত। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা আমাদের জন্য সুন্নাহর অনুসরণ এবং একইসাথে তা একজন ব্যক্তির বিজ্ঞতার পরিচায়ক।
রাসূল (সাঃ) স্বয়ং আমাদের দ্বীনি বন্ধু খুঁজে নিতে উৎসাহিত করেছেন এবং এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, যখন কোন ব্যক্তি একাকী থাকে, শয়তান তখন তাকে পথভ্রষ্ট করবার জন্য টার্গেট বানিয়ে নেয়। যতোক্ষন সে কোন নেক বান্দার সান্নিধ্যে থাকে, শয়তান দূরে অবস্থান করে।
এবং এজন্যই, ভালো লোকেদের সাথে মেলামেশা করা একাকী সময় অতিবাহিত করা, অলস বসে থাকার চাইতে বহুগুণে উত্তম। কেননা, যখন আপনি একাকী থাকবেন, আপনার দ্বারা এমন কোন কাজ হয়ে যেতে পারে যার জন্য পরবর্তীতে আপনি অনুতপ্ত হবেন।
নিরিবিলিতে থাকলে আমাদের মনে এ চিন্তার উদয় ঘটতে পারে যে, কেউ তো দেখছে না। কিন্তু মনে রাখবেন, আল্লাহর সার্বক্ষণিক নজরদারীর গন্ডির বাহিরে যাওয়া কোন মাখলুকের পক্ষে কোনদিন ও সম্ভবপর হবে না। অপরদিকে, পুণ্যবান বন্ধুর সান্নিধ্যে থাকলে সে আপনাকে পাপ হতে বিরত রাখবে এবং সর্বদা উত্তম নসীহত প্রদান করবে।
রাসূল(সাঃ) তার হাদীসে একজন মুমিন বান্দাকে ই নিজের কাছের বন্ধু বানাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আপনার সহকর্মীকে নিজস্ব পছন্দের ভিত্তিতে বাছাই করবার সুযোগ আপনার নেই, কিন্তু কাছের বন্ধু?
আপনার যেকোন আনন্দ, বেদনার মুহুর্তগুলো যার সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পছন্দ করছেন, বাড়ির যেকোন উৎসবে তাকে আমন্ত্রণ করছেন, যেকোন বিপদে যাকে ডাকলে ই কাছে পাওয়া যায়, হতাশার দিনগুলোতে স্বান্তনা দানকারী- সে ই তো আমাদের কাছের বন্ধু।
যেমনভাবে, রাসূলের (সাঃ) পরম বন্ধু ছিলেন আবু বকর (রাঃ)। তাহলে, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রূপে যাকে আমরা বেছে নিচ্ছি, সে যেনো অবশ্য ই মুমিন হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মুমিন হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ঈমানের দাবী সম্বন্ধে সম্যক অবগত এবং তা আদায় করে থাকেন।
যদি আপনি তা না করেন তাহলে কি ঘটতে পারে?
আপনার গোপন কথাগুলো অন্য লোকে জেনে যাবে, আপনাকে দেয়া তার উপদেশ জীবনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে। এ হাদীসে ই রাসূল(সাঃ) আরো উল্লেখ করেছেন, যে তোমার বাড়ির খাবার যেনো মুত্তাকীদের জন্য ই বরাদ্দ থাকে। এখন এর দ্বারা কি এমনটা বোঝানো হয়েছে যে, মুত্তাকী ব্যতীত আর কাউকে খাবার দিয়ে সাহায্য করা যাবে না?
কখনোই না। ফাসিক, কাফির, মুনাফিক্ব যে ই ক্ষুধার্ত থাকুক, প্রত্যেককে ই আমরা সাহায্য করবো। কিন্তু আমাদের বাড়ির বিশেষ দাওয়াতে, বিশেষ অনুষ্ঠানে আমরা যাদের দাওয়াত দিবো, অর্থাৎ যারা আমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠজন, তাঁরা যেনো মুত্তাকী হয় সে ব্যাপারে ই আলোকপাত করা হয়েছে।
উত্তম সঙ্গের উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। স্বাভাবিকভাবেই, যা কিছু নিষিদ্ধ, হারাম তা আমাদের প্রলুব্ধ করে। কিন্তু হারাম কাজগুলোর প্রতি কেউ যদি আমাদের উদ্বুদ্ধ না করে, তাহলে নিজেকে দৃঢ় রাখা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। আপনার সার্কেলের প্রত্যেকেই যদি ধূমপায়ী হয়, তাহলে পাপের দিকে পিছলে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায় যে, আপনি নিজেও ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। নিজেকে বঝাবেন এটা তো নিছক মাকরূহ, বড় কোন গুনাহ না। কিন্তু আপনি তো এতে নিজের ক্ষতি করছেন, যা শরী’আহ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। ঈমান স্ট্রং আপনার। নিজেকে না হয় নিয়ন্ত্রণ করবেন, এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু তা কতক্ষণ স্থায়ী হবে?
অথচ, আপনার বন্ধুরা যদি সৎ প্রকৃতির, ঈমানদার হতেন পাপের প্রতি প্রলুব্ধ হবার বিন্দুমাত্র অবকাশ ও থাকতো না।
এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা স্বয়ং রাসূল(সাঃ) কে সূরা আল কাহফে আদেশ করেছেন,
وَ اصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدٰوةِ وَ الْعَشِیِّ یُرِیْدُوْنَ وَجْهَهٗ وَ لَا تَعْدُ عَیْنٰكَ عَنْهُمْۚ تُرِیْدُ زِیْنَةَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَاۚ وَ لَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهٗ عَنْ ذِكْرِنَا وَ اتَّبَعَ هَوٰىهُ وَ كَانَ اَمْرُهٗ فُرُطًا
অর্থঃ আর নিজের অন্তরকে তাদের সঙ্গলাভে নিশ্চিন্ত করো যারা নিজেদের রবের সন্তুষ্টির সন্ধানে সকাল-সাঁঝে তাঁকে ডাকে এবং কখনো তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরাবে না। তুমি কি পার্থিব সৌন্দর্য পছন্দ করো? এমন কোন লোকের আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণ করেছে এবং যার কর্মপদ্ধতি কখনো উগ্র, কখনো উদাসীন।
(সূরা আল কাহফ, আয়াত ২৮)
অর্থাৎ এমন ব্যক্তিদের সাথে নিজেকে সর্বদা রাখো, যাদের অন্তরে আল্লাহর স্মরণ জাগরুক। তাঁদের প্রতি ফিরে ও তাকাবে না, যাদের অন্তর আমার থেকে গাফেল এবং নিজ মর্জি অনুযায়ী যারা জীবন অতিবাহিত করছে। তাহলে একবার ভেবে দেখুন, রাসূলকে(সাঃ) আল্লাহ সতর্ক করছেন, দুনিয়াবী ভোগবিলাসের বস্তু, চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট হবেন না।
আমরা কোথায় আছি?
আমাদের অবস্থান কোথায়?
চিন্তা করেছেন কি?
ধার্মিক ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকলে তাঁরা আপনাকে সর্বদা একজন মুত্তাকী, মুমিন হবার কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন।
যখন কোন সৎ ব্যক্তি আপনার বন্ধু হবে, কেবল মাত্র তখন ই তিনি আপনাকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উপদেশ, পরামর্শ প্রদান করবেন। এতদ্ব্যতীত প্রত্যেকেই কোন না কোন স্বার্থের বশবর্তী হয়ে উপকার করে থাকে। মুত্তাকীরাই কেবল আল্লাহর প্রতিদানের আশায় নিজ লাভের কথা চিন্তা না করে এঁকে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
এবং, আপনি যখন দ্বীনি বন্ধুর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন, এর মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের হক্ব আদায় হচ্ছে। ভ্রাতৃত্বের মিষ্টি মধুর সম্পর্ক, যার অশেষ উপকারিতা রয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো, উম্মাহর মাঝে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। উম্মাহর বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ি কারণগুলোর মাঝে অন্যতম প্রধান কারণ- বিভক্তি।
জাতীয়তাবাদ, গোষ্ঠীপ্রীতি সহ আরো অনেক বিভক্তির শিকার আমরা। যা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব কেবল, এক মুসলিমের সাথে অপর মুসলিমের প্রকৃত বন্ধুত্বের দ্বারা।
তাহলে বলা যায় যে, দ্বীনি বন্ধু সার্কেল গড়ে তোলা, ঈমানদারদের নিজের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে গ্রহণ করা- ইসলামি শরীআহ’র অংশ। আমরা ক’জন ই বা এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে থাকি..?
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল(সাঃ) বলেন,
الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ. فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
অর্থঃ “মানুষ তার ‘খলীল’ এর দ্বীনের উপর থাকে। অতএব, তোমরা এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে। ”
‘খলীল’ হলো বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়। এমন কেউ, যার সাথে আমরা সময় কাটাতে পছন্দ করি, তার সঙ্গ পছন্দ করি।
এখানে ‘দ্বীন’ বলতে শুধু ধর্ম নয়, বরং আখলাক বা চরিত্র, আচার-আচরণ এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ব্যক্তির সামগ্রিক চলাফেরা প্রভাবান্বিত হয় একজন বন্ধুর দ্বারা।
এখন প্রশ্ন হলো, সর্বশেষ কবে আপনি ‘বন্ধু’ নিয়ে ভেবেছিলেন?
কোন বন্ধু আপনার জন্য ক্ষতিকর, কোন বন্ধু উপকারী, ভেবে দেখেছেন একবার ও?
কিছুসংখ্যক স্কলার, ভালো বন্ধুকে তিনটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করেছেন।
১) পরিপূর্ণ দ্বীন মেইনটেইন।
(যার মাধ্যমে কোন প্রকার খারাপ কাজে তিনি জড়িত হবেন না। একজন প্রকৃত বন্ধু কখনোই আপনাকে জাহান্নামের দিকে টেনে নেবেন না, কেননা তিনি আপনার ক্ষতি করতে চান না।)
২) প্রয়োজনীয় জ্ঞান, বিচক্ষণতা।
৩) আখলাক, বিনয়, আদবকায়দা।
এমন কোন বন্ধু খুঁজে নিন, যিনি একজন ভালো মুসলিম। অধিক উত্তম না হলেও অন্তত ইসলামের জন্য ক্ষতিকর কেউ যেনো আপনার বন্ধু না হন। ইসলাম, সামাজিক মেলামেশাকে নিষিদ্ধ করে নি। কিন্তু এটি বিপদজনক হবে তখন ই, যখন এ মেলামেশা আপনাকে হারামের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।
রাসূল(সাঃ) এর একটি হাদিস উল্লেখ করা যাক। যা বেশ গভীর অর্থ বহন করে। হাদিসটির সারকথা হলো- মানবাত্মা বা মানুষের অন্তর সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর ন্যায় সুসজ্জিত। তন্মধ্যে যে হৃদয়গুলোর মাঝে সংযোগ রয়েছে, তাঁরা একত্রিত হয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। কিন্তু, যে হৃদয়গুলোর মাঝে কোন সংযোগ নেই, তাঁরা স্ব স্থানে থেকে যায়। অর্থাৎ, মনের মিল থাকলে সম্পর্ক বন্ধুত্বে রূপ নিতে খুব একটা সময় লাগে না। বাস্তব জীবনে এমন বহুবার হয়ে থাকে, যে কারো সাথে পরিচয়ের আধ ঘণ্টার মাঝেই আত্মার বন্ধন দৃঢ় হয়ে ওঠে।
তাহলে বলা ই যায় যে, একজন নেককার বন্ধু আপনাকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করবে। এবং, পাপী বন্ধু জাহান্নামের অতল গহ্বরে আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে। এ সম্পর্কে অনেক উদাহরণ কোরআন হাদিস থেকে জানা যায়। আবু বক্বর সিদ্দীক রাদ্বি’আল্লাহু আনহু। যিনি এমনকি নবুয়্যাতের পূর্ব হতেই রাসূল(সাঃ) এর সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়েছিলেন। তাঁদের মাঝে রূহের সংযোগ ঘটেছিলো। ফলশ্রুতিতে প্রথম পুরুষ হিসেবে ইসলাম গ্রহণের মর্যাদা লাভ করলেন, সর্বাধিক সম্মানিত মুসলিম হবার মর্যাদা পেলেন, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীদের মাঝেও সবচেয়ে উত্তম ছিলেন তিনি।
তাহলে দেখুন, এ বন্ধুত্বের ফল কতোটা সুমিষ্ট ছিলো! এ বন্ধুত্ব আবু বক্বরকে(রাঃ) এমনভাবে উপকৃত করলো, যেরূপে আর কারুকে দেয়া হয়নি। কেননা তিনি ছিলেন, ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’ প্রিয় নবী মুহাম্মদ(সাঃ) এর ঘনিষ্ঠ সহচর। এ বন্ধুত্ব তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস পর্যন্ত পৌঁছে দিলো।
وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَىٰ يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلً . وَيْلَتَىٰ لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلً
অর্থঃ “জালেমরা সেদিন নিজেদের হাত কামড়াতে থাকবে এবং বলতে থাকবে, “ হায় ! যদি আমি রসুলের সহযোগী হতাম৷ হায়! আমার দুর্ভাগ্য, হায়! যদি আমি অমুক লোককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম৷”
(সূরা ফুরক্বান, আয়াত ২৭-২৮)
পাপীরা সেদিন অনুতাপে, অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজেদের মাথা কুটবার উপক্রম করবে। কিন্তু তাতে কি ই বা লাভ হবে! তারা বলতে থাকবে, কেনো অমুকের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম, তার জন্য আজ আমার এই দশা, সে আমায় জাহান্নামের পথে টেনে এনেছে! কিন্তু এতোই কি সহজ?
তুমি নিজে কি তার সঙ্গ পছন্দ করোনি?
মেতে থাকো নি হাস্যরসে, দুনিয়াবী ভোগবিলাসে?
তোমার নিজের নফসের খাহেশাতের বদৌলতেই আজ তোমার এই পরিণতি। নাও, এখন তবে ভোগ করো জাহান্নামের আজাবের স্বাদ।
প্রকৃত বন্ধুত্ব আমাদের জীবনে এক পরশ পাথরের ন্যায়। যার ছোঁয়ায় পালটে যেতে পারে জীবনের গতি। তাই বন্ধু নির্বাচনের সময় দ্বীন, ঈমানদারিতা বিবেচনা- খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা ‘আলা আমাদের জীবনে এমন বন্ধু মিলিয়ে দিন, যারা আমাদেরকে পথ দেখাবে সেই মনোহর জান্নাতের দিকে, আল্লাহ আমাদের যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যা চিরস্থায়ী শান্তির আবাস। অসৎ সঙ্গে পড়ে আখিরাতকে হারানো থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আমীন। একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি।
হাসান আল বাসরী [রহিমাহুল্লাহ] বলেছেন, তোমরা পৃথিবীতে ভাল মানুষদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে তৎপর হও, কারন এই সম্পর্কের কারণে হয়ত তোমরা আখিরাতে উপকৃত হতে পারবে।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, কিভাবে?
তিনি বললেন যখন জান্নাতিরা জান্নাতে অধিষ্ঠিত হয়ে যাবে তখন তারা পৃথিবীর ঘটনা স্মরণ করবে এবং তাদের পৃথিবীর বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যাবে। তারা বলবে, আমি তো আমার সেই বন্ধুকে জান্নাতে দেখছিনা, কি করেছিল সে?
তখন বলা হবে, সেতো জাহান্নামে। তখন সেই মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে বলবেন, হে আল্লাহ, আমার বন্ধুকে ছাড়া আমার কাছে জান্নাতের আনন্দ পরিপূর্ণ হচ্ছেনা।
অতঃপর আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলা আদেশ করবেন, অমুক ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাতে।
তার বন্ধু জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেল এই কারনে নয় যে সে তাহাজ্জুদ পড়ত বা কুরআন পড়ত বা সাদাকাহ করত বা রোজা রাখত, বরং সে মুক্তি পেল কেবলই এই কারণে যে তার বন্ধু তার কথা স্মরণ করেছে। তার জান্নাতী বন্ধুর সম্মানের খাতিরে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হল।
জাহান্নামিরা তখন অত্যন্ত অবাক হয়ে জানতে চাইবে কি কারনে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হল, তার বাবা কি শহিদ? তার ভাই কি শহিদ?
তার জন্য কি কোন ফেরেশতা বা নবী শাফায়াৎ করেছেন?
বলা হবে না, বরং তার বন্ধু জান্নাতে তার জন্য আল্লাহর কাছে অনুরোধ করেছে।
এই কথা শুনে জাহান্নামিরা আফসোস করে বলবে হায় আজ আমাদের জন্য কোন শাফায়াৎকারি নেই এবং আমাদের কোন সত্যিকারের বন্ধু নেই, যার উল্লেখ আছে এই আয়াতগুলোতে:
فَمَا لَنَا مِن شَافِعِينَ
অতএব আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই।
وَلَا صَدِيقٍ حَمِيمٍ
এবং কোন সহৃদয় বন্ধু ও নেই।
[সূরা আশ-শো’আরা-১০০-১০১]
মূলঃ ড.ইয়াসির ক্বাদি