বন্ধুত্ব এবং অতঃপর

‘বন্ধুত্ব’। ছোট্ট এই শব্দটিতে লুকিয়ে থাকে হাজারো স্বর্ণালী মুহূর্ত, দুষ্টুমি, খুনসুটি… আরও কত কী!
বন্ধু…বোঝে আমাকে…’ – এই লাইনটি সবারই জানা। বন্ধুরা হয়তো এরকমই হয়। তাদের সাথে মনের মিল থাকে বলেই বন্ধুত্বের রঙিন দুনিয়ায় হাতে হাত ধরে হারিয়ে যাওয়া যায় দূর অজানায়৷

আমরা অন্যের সাথে বন্ধুত্ব কেন করি?
অজানা মানুষকে জানার আকাঙ্ক্ষা, সময় কাটানোর সাহচর্য খোঁজা, জীবনের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়ার জন্যই মূলত আমাদের জীবনে এই মানুষগুলোর আবির্ভাব ঘটে। আবার, অনেকসময় এতকিছু না চাইতেও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সময়, পরিস্থিতির স্রোতে কিছু মানুষ আত্মার আপন হয়ে জড়িয়ে যায় জীবনের সাথে।

আকাশ আর মেঘের মিতালির মতই বন্ধুত্বের মাঝে মিশে থাকে ভালোবাসা। যখনই এই মধুরতাকে ‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা’ হিসেবে মেনে নেয়া যাবে, তখনই সেই বন্ধুত্ব চিরসবুজের যাত্রায় অগ্রগামী হবে। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সমাপ্তিতে যে অসীম জান্নাত বিস্তৃত, তার হাতছানিতে তো এ সম্পর্ককে আল্লাহর পথে নিয়ে আসাই যায়।

ইরশাদ রয়েছে, আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন (হাদিসে কুদসিতে) বলেছেন, ‘আমার ভালোবাসা অনিবার্য হয়ে যায় ওই ব্যক্তিদ্বয়ের জন্য, যারা একে অন্যকে ভালোবাসে (কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য থেকে নয়) আল্লাহর জন্য।
[মুসনাদে আহমাদ: ২২০৮৩]

‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা’ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি?
আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টায় একে অপরকে ভালোবাসা, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করা- এটাই তো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।

বন্ধুত্বের সম্পর্কে মিশে থাকে মধুরতা, এক অন্যরকম দাবী। এই দাবীর জের ধরেই আমরা একে অন্যকে ডাকতে পারি আল্লাহর পথে, সকল কল্যাণের কাজে। সেটা হতে পারে একসাথে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা, কুরআন কিংবা হাদীসের কোনো অংশ মুখস্থকরণ, একে অন্যের কাছে উম্মাহ নিয়ে ভাবনার ডালপালা মেলে দেয়া, দুস্থ-অভাবীদের সাহায্যে এগিয়ে আসা… আরও অনেক কিছু।

বন্ধুর কাছে মনের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ ঢেলে দেয়া যায় বলে আমরা অনেকেই হয়তো অন্যের সমালোচনা করে আনন্দ পাই। বর্তমান প্রজন্ম যাকে বলে ‘বিচিং করা’। অন্যের দোষকে হাজার রকম অ্যাংগেল থেকে বিবেচনা করেই হয়তো আমাদের অনেক সময় কেটে যায়৷ পরিশেষে সেই একই কথা, “থাক বাদ দে। আমাদের কী!” আসলেই।

অন্যের দোষ নিয়ে এত কাটাছেঁড়া করে আমাদের কী লাভ?
দুনিয়াতেও আরেকটা মানুষের কষ্টের কারণ হওয়া (সে যদি জানতে পারে) এবং সেইসাথে আখিরাতে যন্ত্রণার হুঁশিয়ারি। তাইতো এই ধরনের কথা থেকে দশ হাত না, একশো হাত দূরে অবস্থান করতে হবে। কেউ একজন ভুলে বলতে শুরু করলেও তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে থামিয়ে দিতে হবে। এটাই বন্ধুত্বের, ভালোবাসার দাবি। যে ভালোবাসা আল্লাহর জন্য হয়, সে ভালোবাসায় কোনো কালিমা থাকতে পারে কি?

আমরা খুব সাধারণ। অজান্তে কিংবা হুট করেই অসংখ্য গুনাহের ফাঁদে পা দিই। সেই গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা না চেয়ে যদি তা অন্যদের কাছে বলে বেড়াই, সেটা কি ঠিক হবে?
কিন্তু আমরা তাই-ই করি। বন্ধুদের সাথে জীবনের অনেক কথাই অবলীলায় বলে ফেলা যায় দেখে গুনাহের ব্যাপারেও শেয়ার করে ফেলি। হোক সেটা ছোট কিংবা বড়। এ ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেছেন, “আমার উম্মাতের মধ্যে ‘মুজাহারা’ ছাড়া সকলকে ক্ষমা করা হবে।

মুজাহারা‘ হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে রাতে কোনো গুনাহ করেছে আর আল্লাহ তার অপকর্মকে গোপন রাখলেন। কিন্তু লোকটি সকালে লোকদের ডেকে বলতে থাকল, ‘হে অমুক আমি রাতে এই এই… কাজ করেছি।’ রাতে তার রব তাকে গোপন করল আর সকালে সে আল্লাহর গোপন করা বিষয় প্রকাশ করে দিল।”
[বুখারি: ৫৭২১]

এ কারণেই যেন বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে আমরা গুনাহের প্রসারে সহায়তা না করি। বন্ধুত্ব হবে এমন সৌন্দর্যমন্ডিত, যেখানে থাকবে না কোনো কদর্যতা।

“এক মু’মিন অপর মু’মিনের জন্য আয়না স্বরূপ।”
[আবু দাউদ: ৪৯১৮]

এই হাদীসটি বন্ধুদের ক্ষেত্রে মানা সবচেয়ে সহজ বলে আমার মনে হয়। কেননা, বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এতই সহজ এবং সুন্দর, যেখানে হক্ব কথা খুব সহজে মেনে নেয়া যায়, তেমন কোনো বাকবিতণ্ডা ছাড়াই। আমার খুব কাছের এক বন্ধু যদি আমাকে বলে, “তোর এই ব্যাপারটা কিংবা এই কথাটা বলা উচিত হয়নি রে” – তখন নিশ্চয়ই আমি তার উপর রেগে যাবো না। বরং ভেবে দেখবো আসলেই সেটা ঠিক হয়েছে কিনা। এভাবেই একে অপরের আয়না হয়ে নিজেদের ভুল শুধরে ‘বন্ধু’ নামক এই মানুষগুলোর সাহচর্যেই আমরা হতে পারি আরও সুন্দর, আরও উত্তম।

বলা হয়ে থাকে- “ভালো কাউকে বন্ধু বানাও এবং মন্দ কারো বন্ধু হয়ে যাও।” যদিও প্ল্যান প্রোগ্রাম করে খুব কম মানুষই জীবনে বন্ধু হয়ে আসে। তবুও… এই কথাটির গূঢ়ার্থ হচ্ছে- ভালো কারো সাহচর্য নিজেকে আরও ভালো হতে উৎসাহিত করবে৷ এজন্যই জীবনে ভালো বন্ধুর প্রয়োজন। সেই সাথে খারাপ কাউকে আমি যেন ভালো সাহচর্যে নিয়ে আসতে পারি, সেই চেষ্টা করা। কিন্তু তা বলে এমন হলে চলবে না যে, আমি নিজেই পা পিছলে নর্দমায় পড়ে গেলাম। অর্থাৎ, নিজের সামর্থ্যের প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে৷

সেদিন জুম্মাহর নামাজে গিয়ে শুনি (আমাদের বাসার পাশের মসজিদে মেয়েদের জুম্মাহ আদায়ের ব্যবস্থা আছে) খতীব সাহেব বন্ধু সম্পর্কে হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহর ঐ বিখ্যাত উক্তিটি বলছেন- জান্নাতী বন্ধুর সম্মানের খাতিরে আল্লাহ খারাপ বন্ধুটিকেও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। সুবহান আল্লাহ!
মসজিদে বসে ওই খুতবা শোনার সময় আমি আমার কাছের বন্ধুদের ভীষণভাবে অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল- ইশ! আমরা সবাই যদি একসাথে আজকের খুতবা শুনতে পারতাম!

কিয়ামতের সেই কঠিন ময়দানে আজকের এই পনের বিশটা হাত একত্রে আবদ্ধ থাকবে তো? ভয় হয় খুব….
কুরআনে তো আল্লাহ বলেই দিয়েছেন, “বন্ধুগণ সেদিন (কেয়ামতের দিন) একে অন্যের শত্রু হবে। তবে মুত্তাকি বন্ধুরা থাকবে ব্যতিক্রম।”

الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ
বন্ধুবর্গ সেদিন একে অপরের শত্রু হবে, তবে খোদাভীরুরা নয়।
[সূরা যুখরুফ:৬৭]

যেই বন্ধুত্ব টেনে নিয়ে যায় জাহান্নাম পানে, সেই বন্ধুত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে আমরা প্রস্তুত তো?
‘দু’আ’ সবসময়ই আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। রবের কাছে চাওয়ার মাঝে রয়েছে এক অন্যরকম প্রশান্তি। সেই চাওয়াটা যদি হয় বন্ধুর জন্য, তবে তাতে আরও বেশি মাত্রায় ভালোবাসা মিশে থাকে বৈকি। আমাদের অনেকেরই হয়তো এমন বন্ধু আছে, যাদেরকে আমরা খুব করে জান্নাতে পেতে চাই। তাদের অনেকের পথেই হয়তো ঝুলছে কাঁটাতারের বেড়া।

তাদের জন্য আমাদের দু’আ যেন শ্রাবণের বারি হয়ে ঝরে, অবিরত। দুনিয়ার জীবনে যেই মানুষগুলো কোনো না কোনো কারণে আমাদের হৃদয়ে আসন গেড়েছে, তাদেরকে এবং আমাদেরকে যেন রাব্বুল আ’লামীন হেদায়েত দান করেন এবং এই পথেই অবিচল রাখেন।
“ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, সাব্বিত ক্বালবি আ’লা দ্বীনিক।”
[তিরমিযী :২১৪০]

এভাবেই বন্ধুত্বের মিষ্টি মধুর সময়গুলো ব্যয় হোক আল্লাহর জন্য। জান্নাতের ফুল বাগানে সেই অনাবিল আনন্দে পূর্ণ পুনর্মিলনীর আকাঙ্ক্ষায় এইটুকু তো করাই যায়।

(বি.দ্র: লেখার সৌন্দর্য রক্ষার্থে বান্ধবীর স্থলে ‘বন্ধু’ লেখা হয়েছে। এখানে হালাল সম্পর্কের উপরই আলোকপাত করা হয়েছে।)

লিখেছেন

উম্মাহর কল্যাণে নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্য বিলিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টারত।

Exit mobile version