ফিলিস্তিনে ভ্রমণ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান দাঈ শায়েখ Mohammad Hoblos এর অনুভূতি-
ফিলিস্তিনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা জর্ডান যাই। সেখান থেকে বাসে করে আমরা সামনে যেতে শুরু করি। সীমান্তের কাছাকাছি গেলেই ইসরায়েলের পতাকা দেখতে পাবেন। অনেক উঁচুতে উড়ছে। এটা দেখেই আপনার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাবে। তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি টের পাবেন। কিছুটা ভয়, কিছুটা ক্ষোভ, কিছুটা হতাশা। যেহেতু আমি অস্ট্রেলিয়ান, তাই আমার অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট লাগবে।
যখন আপনি প্রথমবারের মত ইসরায়েলিদের দেখবেন। হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাবে। মনে হবে শরীরে যেন বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেলো। তাদের কাছে গেলে তারা হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাবেনা। নিজেকে একজন নির্বাসিত ব্যাক্তি ভাবতে ওরা আপনাকে বাধ্য করবে।
বর্ডারে পৌঁছালে ওরা আপনাকে বাস থেকে নামিয়ে দিবে। এবং ভিতরে গিয়ে আপনাকে এক জায়গায় বসে থাকতে হবে। ৩ ঘন্টা, ৪ ঘন্টা, ৫,৬,৭,৮ ঘন্টা। এত সময় পরেও আপনাকে প্রশ্ন করা হবেনা। আপনি ফিলিস্তিনে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক, কিন্তু আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখবে।
বসে থাকার সময় দেখবেন একজন ফিলিস্তিনের নাগরিক যাকে আমরা চাচা বা হাজী বলে সম্বোধন করি, ৭০-৭৫ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ মানুষ। আর ১৭-১৮ বছর হবে এমন বয়সী ইসরায়েলী নারী সেনা সেই বৃদ্ধ লোকটির সাথে কথা বলছে।
এমনভাবে অর্ডার দিচ্ছে মনে হচ্ছে বৃদ্ধ লোকটি কোনো জন্তু জানোয়ার। মনে হয় লোকটি কোনো মানুষই নয়, যেন জন্তু জানোয়ার। সেই ইসরায়েলী নারীটি কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে বৃদ্ধ লোকটিকে অর্ডার দিচ্ছে।
আর আপনি কষ্টটা অনুভব করতে পারবেন। আর সেখানে দাঁতে দাঁত চেপে আপনাকে এটা সহ্য করতে হবে। এই লোকটি ফিলিস্তিনের অধিবাসী। এই ফিলিস্তিনি লোকটি যেখানে সম্মান পাওয়ার কথা সেখানে ১৮ বছরের একটি মেয়ে অর্ডার দিচ্ছে।
যাইহোক সেখানে বসে থাকার পর আপনাকে ডাকা হবে। সেখানে নারীর উপস্থিতি কাকতালীয় নয়, সে আপনাকে ডাকলে আপনি তার সাথে ভিতরে গিয়ে অন্য রুমে বসতে হবে। আপনাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি কে? কেন ইসরায়েলে এসেছো?
তোমার এখানে কাজ কি?
হজ্ব শেষে বাড়ি না গিয়ে কেন এখানে এসেছো? এভাবে প্রশ্ন করতেই থাকবে আধা ঘন্টা ধরে। আবার চলে যাবে।
দুই তিন ঘন্টা পর আবার এসে আবার প্রশ্ন করবে। এরপর আপনাকে আরেক যায়গায় পাঠাবে। সেখানে ১,২ ঘন্টা বসে থাকার পর আবার আপনাকে একই প্রশ্ন করবে। এভাবে চলতে থাকবে। এরপর আপনার ফিলিস্তিনে যাওয়ার ইচ্ছে মরে যাবে। এবার তারা যেতে দিবে।
আপনি ইসরায়েলে প্রবেশ করলেই তাদের শোষণ টের পাবেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মাইলের পর মাইল কনক্রিটের উঁচু দেয়াল দেখতে পাবেন। মাইলের পর মাইল কংক্রিটের দেয়ালগুলো ফিলিস্তিনিদের আলাদা করে রেখেছে। শহরের ভেতরের দেয়ালগুলোতে এমনভাবে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে যেন সব নরমাল মনে হয়।
এরপর যখন আপনি মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করতে যাবেন। দেখবেন ইসরায়েলী সেনারা চারদিকে ঘিরে আছে। তার কাছে আপনার পাসপোর্ট আইডি সব দেখাতে হবে। এক ইসরায়েলী সেনা যার কাছে অটোমেটিক অস্ত্র রয়েছে তাকে বলতে হবে আমি কেন আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করতে চাই।
যাই হোক এগুলার পর মসজিদে প্রবেশ করবেন। ভেতরে গিয়ে মনে হবে মসজিদের দেয়ালগুলো যেন কাঁদছে। সেখানে কোনো যুবক নেই। কারন সেখানে তাদের প্রবেশাধিকার নেই। ভেতরে আপনি গ্লাসের তৈরি স্ট্রান্ড দেখতে পাবেন যেখানে বোমা, গোলাবারুদ ইত্যাদি রাখা আছে। যেগুলো বিভিন্ন সময়ে এই মসজিদে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বোমার গায়ে লেখা Made in USA.
ইশার নামাজের পর ভাববেন যে আরো একটু ইবাদত করি। কিন্তু তা অসম্ভব কারন তারা মসজিদে তালা লাগিয়ে দিবে। রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে আপনাকে বের হয়ে যেতে হবে। কিন্তু ইসরায়েলিরাই সবশেষে মসজিদ পরিদর্শন করবে। তারা কি মসজিদকে সম্মান করে খালি পায়ে প্রবেশ করবে? না মোটেই না।আর সবকিছু আপনার সামনে ঘটলেও আপনি কিছু বলতে পারবেন না।
ফিলিস্তিনিদের যদি আপনি প্রশ্ন করেন মুসলিমরা কোথায়? এখানে এত কম মুসলিম কেন?
তারা বলবে, মসজিদে আসতে গেলে কমপক্ষে পাঁচবার আইডি কার্ড আর পাসপোর্ট দেখাতে হয়। একজন স্থানীয় লোকের মসজিদে প্রবেশ করতে ৫ বার আইডি, পাসপোর্ট দেখাতে হয়। আর যদি সে পাসপোর্ট আনতে ভুলে যায় তার ক্ষতি হতে পারে। তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হতে পারে।
৭ কি.মি যেতে তাদের দুইবার থামতে হয়। গাড়ি থেকে নেমে দুইবার আইডি দেখাতে হয়। স্ত্রী সাথে থাকলে তাকেও নামতে হয়। পুরো গাড়ি সার্চ করে তারা। প্রতিদিন এটা চলতে থাকে। আর কাউকে যদি সেই পথে ২-৪ বার সেই পথে চলতে হয় তাকেও সেই একই পরিচিত গার্ড আগের মত চেক করে।
এমন সময় আপনার কেমন লাগবে? এত বাজে ব্যাপার।
তো আমরা হাইওয়ে দিয়ে চলতে চলতে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি দেখছিলাম। আর হঠাৎ এমন কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখছিলাম যেগুলো সেখানে থাকার কথা ছিলোনা।
দেখলাম ঝোপের মাঝে একটা কন্টেইনার পড়ে আছে। জানেন সেগুলো কেন আছে? ফিলিস্তিনের জমিতে কোনো এক ইসরায়েলী তার কন্টেইনার রেখে দিয়েছে।
সে এসে এখানে বসে থাকে। কিছু করে না। এভাবে মাস, বছর দেখে আপনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। যখন কোনো ফিলিস্তিনি আর প্রশ্ন করেনা এই কন্টেইনার সম্পর্কে, তখন সেই ইসরায়েলী এখানে বাড়ি তৈরি করে। সে জমি তার হয়ে গেল! সব যায়গায় এমন ছোট ছোট কন্টেইনার দেখতে পাবেন।
সময় শেষ। আরো কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, যখন আমরা মসজিদে খলিলে প্রবেশ করি যেখানে ইবরাহিম (আ) কে কবরস্থ করা হয়। আমি বাড়িয়ে বলছিনা। ইতিহাস ঘেটে দেখেন মসজিদে খলিল মুসলিমদের অধিকারে ছিল।
১৯৯৪ সালে যখন মুসলিমরা এখানে ফজরের সালাত আদায় করছিলো এক ইহুদি ডাক্তার সেখানে গিয়ে সিজদারত মুসলিমদের গুলিবর্ষণ করে। ৩০ জনকে হত্যা করে ১২৫ জনকে আহত করে।
এরপর কি হয়েছিলো জানেন?
ইসরায়েলীরা মসজিদটি বন্ধ করে দেয় এবং তদন্ত শুরু করে দেয়। সেই তদন্ত শেষে তারা মসজিদের অর্ধেক দখলে নিয়ে ইহুদি উপাসনাগার বানায়। আর সেই অমানুষ (ডাক্তার) তাকে কি বলবো আমি জানিনা, তার কবরটি মন্দিরে পরিণত হয়। এবং কট্টর ইহুদিরা সেখানে গিয়ে তার কবরের কাছে প্রার্থনা করে।
তাকে হিরো বলে।
ওয়াল্লাহি, আপনি ফিলিস্তিনে গিয়ে দেখবেন যা টিভিতে দেখেন তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহর কসম সেখানকার অত্যাচার একজন মুসলমি এর চোখের দিকে তাকালে দেখতে পারবেন। তাদের চোখ দেখলে বুঝতে পারবেন তারা অন্য মুসলিম ভাইদের আশা করে আছে। সময় কম তাই আরো অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারলাম না।
ইসরায়েলীরা চায় আপনি ফিলস্তিনকে ভুলে যান। এটাই সত্যি। তারা টাকা, ট্যুরিজম কিছুই চায় না। তারা চায় আপনি(মুসলিম) আর ফিলিস্তিনিরা যাতে ধ্বংস হয়ে যায়। যখন সেই জায়গার নাম মুসলিমদের হৃদয় থেকে মুছে যাবে তখন তারা সার্থক।
কখনো ভেবে দেখেছেন আমরা ফিলিস্তিন সম্পর্কে এত কম জানি কেন?
মসজিদ আল কুদসের ইমামের একটা অনুরোধ পেশ করে শেষ করছি। তিনি আমাকে বলেন, “দয়া করে ফিরে যান। আর মুসলিম যুবকদের বলেন তারা যেন এখানে আসে। এবং তারা বুঝতে পারবে ফিলিস্তিনে যা ঘটছে তা পুরোপুরি বাস্তব।”