প্রতি সপ্তাহে কবর জিয়ারত করা এবং জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত সফর করার বিধান। কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূরে কোথাও যাওয়া নাকি নিষেধ? কিন্তু আবার অনেকেই বলে যে, সপ্তাহে একদিন কবর জিয়ারত করা উচিত। কথা দুটি পরস্পর বিরোধী হয়ে গেছে না? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।
কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন, ক্ষণ, সপ্তাহ বা মাস নাই। বরং যখন খুশি তখনই জিয়ারত করা যাবে। প্রতি শুক্রবার, প্রতি সপ্তাহে একবার, প্রতি মাসে একবার, দু ঈদের রাতে, কথিত শবে বরাতের রাতে….এমন কোন নির্দেশনা ইসলামে আসে নি। সুতরাং কবর বাসীদের প্রতি সালাম প্রদান, তাদের জন্য দুআ করা এবং মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করার উদ্দেশ্যে যখন সুবিধা হয় পুরুষদের জন্য কবর জিয়ারত করা বৈধ।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে,
زَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ ، ثُمَّ قَالَ : “ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِي ، وَاسْتَأْذَنْتُهُ أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথে যে সাহাবীগণ ছিলেন তারাও কাঁদলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “আমি মায়ের কবর যিয়ারতের জন্যে আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। আর তার মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে সে অনুমতি প্রদান করা হয় নি। অতএব তোমরা কবর জিয়ারত কর। কেননা কবর জিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। ”
[সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬, মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, অধ্যায়: কিতাবুল জানায়েয, অনুচ্ছেদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করা। হা/১৪৩০]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
أَلا فَزُورُوهَا ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ
“সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারত কর, কেননা এতে আখিরাতের কথা স্মরণ হয়।”
তাই আমরা আমাদের সুবিধাজনক সময়ে কবর জিয়ারত করতে যাবো। এতে আমাদের মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ হবে।
শুধু কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত সফর করার বিধান:
অধিক বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী কেবল কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত সফর করা জায়েজ নাই। চাই তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর হোক বা অন্য কোন কবর হোক। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা, মসজিদে নব্বী ও মসজিদুল আকসা এই তিনটি মসজিদ ছাড়া কোন স্থান থেকে আলাদা সওয়াব লাভের নিয়তে বা রবকত লাভের আশায় সফর করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, এটি শিরকের মাধ্যম।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا تَشُدُّوا الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِ الرَّسُولِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَسْجِدِ الْأَقْصَى
“তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন কোথাও (বিশেষ বরকত ও ফযিলত পূর্ণ স্থান মনে করে) সফর করো না। সেগুলো হল: মসজিদুল হারাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদ এবং মসজিদুল আকসা।”
(বুখারিও মুসলিম)
বাসরা বিন আবী বাসরা গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি আবু হুরাইরাহ্ (রা.) কে তুর পাহাড় থেকে আসতে দেখে বললেন:
لَوْ أَدْرَكْتُكَ قَبْلَ أَنْ تَخْرُجَ إِلَيْهِ لَـمَا خَرَجْتَ، سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ: لاَ تُعْمَلُ الْـمَطِيُّ إِلاَّ إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ: الْـمَسْجِدِ الْـحَرَامِ، وَمَسْجِدِيْ هَذَا، وَالْـمَسْجِدِ الْأَقْصَى
‘‘আমি আপনাকে তুর পাহাড়ের দিকে যাওয়ার পূর্বে দেখতে পেলে অবশ্যই আপনি বের হতেন না। কারণ, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি: ( (বিশেষ বরকত ও ফযিলত পূর্ণ স্থান মনে করে) তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফর করা যাবে না। সে মসজিদগুলো হলো: মসজিদে হারাম, আমার এই মসজিদ (মদিনার মসজিদে নববী) ও মসজিদে আকসা’’।
(মুআত্তা মালিক : ১/১০৮-১০৯ আহমাদ : ৬/৭ ’হুমাইদী, হাদীস ৯৪৪, শাইখ আলবানি বলেন, এ হাদিস বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহিহ। ইরওয়াউল গালিল ৪/১৪১)
উক্ত হাদিস দ্বয়ের আলোকে একদল আলেম বরকত ও সওয়াব লাভের নিয়তে কোন কবর, মাজার, দরবার, বিশেষ কোন স্মৃতি স্থল ও কথিত পুণ্যভূমি, এমনকি রাসূল সা. এর মসজিদ সালাত আদায়ের উদ্দেশ্য ছাড়া কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর থেকে সফর করাকে নাজায়েজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
জাহেলি যুগের লোকেরা, তুর পাহাড়, সিনাই পর্বত, ঈসা আ. এর জন্মস্থান, পূর্ববতী বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাধিস্থল ইত্যাদি বরকত লাভের উদ্দেশ্যে সফর করত। ইসলাম সে সব জাহেলি ধ্যান-ধারণাকে উৎখাত করে স্থানগত মর্যাদা কেবল এ তিনটি মসজিদে জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।
সুতরাং ইলম চর্চা, দ্বীনের দাওয়াত, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরি, পর্যটন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে একদেশ থেকে আরেক দেশ, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ভ্রমণ করা এ হাদিসের অন্তর্ভূক্ত নয়।
শাইখ আবু মহাম্মদ আল জুওয়াইনী (ইমামুল হারামাইন খ্যাত আবুল মাআলী আল জুওয়াইনীর পিতা, মৃত্যু: ৪৩৮ হিজরি/১০৪৭) বলেন:
يحرم شد الرحال إلى غيرها عملا بظاهر هذا الحديث وأشار القاضي حسين إلى اختياره وبه قال عياض وطائفة، ويدل عليه ما رواه أصحاب السنن من إنكار بصرة الغفاري على أبي هريرة خروجه إلى الطور وقال له: لو أدركتك قبل أن تخرج ما خرجت، واستدل بهذا الحديث فدل على أنه يرى حمل الحديث على عمومه ووافقه أبو هريرة.
“এ হাদিসের বাহ্য অর্থের উপর আমল করলে এই তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও (বরকত হাসিল বা পুণ্যভূমি মনে করে) সফর করা হারাম। কাজি হুসাইন এই মতটি গ্রহণ করার দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন আর কাজি ইয়াজ সহ একদল আলেম এ কথাই বলেছেন।
এর দলিল হল, আসহাবুস সুনান (তথা আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি। তা হল: বাসরা আল গিফারি আবু হুরায়রা রা. এর তুর পাহাড়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করার পর এই হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি এই ব্যাপক অর্থেই হাদিসটিকে প্রযোজ্য মনে করতেন আর আবু হুরায়রা . ও তার সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন।”
মদিনা জিয়ারতের উদ্দেশ্য হবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদে সালাত আদায় করা। কেননা সেখানে এক রাকআত সালাত কাবা শরীফ ছাড়া অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক হাজারগুণ বেশি সওয়াবের। মসজিদে নব্বীতে সালাত আদায় করার পর করণীয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর, তাঁরপাশে অবস্থিত তাঁর দু সাথী আবু বকর রা. ও উমর রা. এর কবর এবং তার সন্নিকটস্থ বাকি গোরস্থান জিয়ারত করা।
দু:খজনক বাস্তবতা হল, বর্তমানে অনেক মানুষকে দেখা যায় যারা, বহু দূর-দূরান্ত থেকে বাস রিজার্ভ করে বা ভিসা-টিকেট নিয়ে শাহজালাল, শাহপরান, শাহ মাখদুম, বাইজিদ বোস্তামি, ভারতের আজমির শরিফ, বড়পীর (!) খ্যাত ইরাকের আব্দুল কাদের জিলানী রহ. এর মাজার ইত্যাদি জিয়ারত করতে যায়। উপরোক্ত হাদিস দ্বয় এবং সালাফদের ব্যাখ্যার আলোকে তা হারাম বলে প্রতীয়মান হয়।
তবে যদি নিজস্ব এলাকায় বা বাড়ির আশেপাশে কবর থাকে অথবা যদি পর্যটন বা কোন কাজের উদ্দেশ্যে দূরে কোথাও যাওয়া হয় এবং সেখানে কবর/মাজার থাকে তাহলে তাহলে এ সকল কবর বাসীর উদ্দেশ্যে সালাম প্রদান, দুআ করা এবং শিক্ষা নেয়ার উদ্দেশ্যে জিয়ারত করায় কোনও আপত্তি নাই। এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী আলেমদের এবং বর্তমান যুগের সৌদি আরবের বড় আলেমদের ফতোয়াও রয়েছে।
আল্লাহ আমদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন।
আমীন।