وَ اَنْذِرْ عَشِیْرَتَكَ الْاَقْرَبِیْنَۙ
وَ اخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِیْنَۚ
অর্থঃ নিজের নিকটতম আত্নীয়-পরিজনদেরকে ভয় দেখাও। এবং মু’মিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের সাথে বিনম্র ব্যবহার করো।
(সূরা আশ-শু’আরা, আয়াতঃ ২১৪-২১৫)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা রাসূল(সাঃ) কে সূরা আশ শু’আরার শেষের দিকের আয়াতে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তিনি তার আপনজনেদের ভীতি প্রদর্শন করেন। মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় আত্মীয় স্বজনের প্রতি খুব সচেতনভাবে খেয়াল রাখতেন এবং অগ্রাধিকার প্রদান করতেন যেন তারা অবশ্য ই ইসলামের বার্তা পায়।
এখন, পরিবারের কাছে ইসলামের সুমহান বার্তা পৌঁছে দেবার কথা বলবার আগে আমাদের আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত।
তা হলো- পরিবারের সদস্যদের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন। বেশিরভাগ সময়েই এমন হয়ে থাকে যে, পরিবারের সবার সাথে আমাদের সম্পর্ক কম বেশি খারাপ থাকে। আমরা বাধ্যগত নই, অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনকিছু বুঝবার জন্য প্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা ও আমাদের মাঝে নেই। স্বামী-স্ত্রী, পিতামাতা ও সন্তান এবং ভাইবোনের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কে এরকমটা হতে পারে। প্রায়ই হয়তো আমরা একে অপরকে নানারূপ হীন কথাবার্তা বলে থাকি। কারণ আমরা একই পরিবারের। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে পারস্পরিক সমস্ত কথাবার্তা জানি বলে আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে এরূপ কথাবার্তার আদানপ্রদান, যা সর্বদা কষ্ট ই দিয়ে থাকে।
এমনকি এটি একটি রীতি হয়ে গিয়েছে। যেকোন কথার জবাবে সমান অথবা অধিক বেদনাদায়ক শব্দ দ্বারা উত্তর দেয়া হয়। এবং ফলশ্রুতিতে পরিবারের সদস্যদের মাঝে মন্দ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রায়শই পুনঃ পুনঃ যাচাই ও চিন্তা করা উচিত, যে প্রকৃতপক্ষে আমাদের জীবনে কারা অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। আপনি কেমন তা যাচাই বাছাই করবার একটি পরীক্ষিত মানদণ্ড হলো- আপনার পরিবারের কাছে আপনি কেমন- সেটি জেনে নেয়া। প্রাত্যহিক নানা কাজের সুবাদে হয়তো অফিসের কলিগ, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা করতে হয়। কিন্তু তারা আমাদের জীবনের শুধুমাত্র ক্ষুদ্র একটি অংশ সম্বন্ধে জ্ঞাত।
আমার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সে ই জানবে, যার সাথে আমি অনেকটা সময় কাটাই। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেটি হলো- আমাদের পরিবার, যা প্রত্যেকের জন্য ই অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তারা ই আমার অন্তর্হিত হীন মানসিকতাসম্পন্ন আচরণগুলোর শিকার হন। ঔদ্ধত্যপূর্ণ, অবাধ্য, অসহিষ্ণু এক আমি কে ই তারা দেখতে পান।
তাই একজনকে কিছুটা থেমে চিন্তা করতে হবে যে, আমি কেমন মানুষ! এমন, যে কীনা নিজের পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে অক্ষম প্রমাণিত হয়েছে! একটি সাধারণ বাক্যালাপ ও আমি স্বাভাবিক মেজাজে চালিয়ে নিতে পারছি না। স্ত্রীর সাথে আমি কোন মধুর আলাপ তো দূরে থাক, ‘চাবি কোথায়’ তা জানতে চাওয়া ব্যতীত কোন অতিরিক্ত কথা ও বলি না। যখন সে কথা বলে, তাতে আদতে কর্ণপাত করি না। ‘হ্যাঁ, হু, আচ্ছা’ জাতীয় টুকরো অমনোযোগী উত্তর দিয়ে দায় সারবার চেষ্টা করি। এবং সে এটি খেয়াল ও করছে।
অতঃপর আপনি আশ্চর্য হয়ে যান যখন তাকে তার বান্ধবীদের সঙ্গে অধিক গল্প করতে দেখছেন। এরূপ আচরণ স্বামী, স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই একজন ব্যক্তির উচিত সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা- যে আমি আসলে কেমন হতে পেরেছি। এমন না যে শুধু ধর্ম না মানা ব্যক্তিরা এরূপ করে থাকেন। বরং পারস্পরিক সম্পর্কের এই ক্ষেত্রে মানসিকতা অনেক বড়ো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
সৃষ্টিগতভাবেই পুরুষেরা চাপা স্বভাবের হয়ে থাকে। আবেগ অকপটে প্রকাশ করতে আমরা অতোটা অভ্যস্ত নই। এজন্য এটা ভেবে থাকি যে, আমরা যা করছি তার হয়তো কোন অনুভূতি সংক্রান্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা নেই। অফিস থেকে বাসায় ফিরে আপনি ইউটিউবে ভিডিও অথবা টিভিতে খবর দেখতে বসে গেলেন। কিংবা কম্পিউটারে কাজ করতে থাকলেন অথবা বন্ধুর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডায় মেতে গেলেন।
আপনার কাছে হয়তো এটি ভুল কোন কাজ বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু আপনার পরিবার ভাবছে উলটো। তাদের কাছে এরূপ আচরণ অবহেলার পরিচায়ক। তারা ভাবছে, আপনি নিজেক্র নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন এবং তাদেরকে সময় দিচ্ছেন না।
তাই সর্বপ্রথম কাজ হলো, নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। অন্যদের সমস্যা, চাওয়া-পাওয়া সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। ইস্যুগুলো তাদের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে চিন্তা করবার চেষ্টা করুন, যেটা সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা অর্জন করা যাবে না। এবং এটি আয়ত্ত করা সত্যিই বেশ দুষ্কর।
যখন আপনি পরিবারের সদস্যদের নিকট ক্ষমা চাইতে সমর্থ হবেন। তাদের কাছে নতিস্বীকার করবেন এই বলে যে, আসলেই আমার দ্বারা এমনটি হওয়া উচিত ছিলো না। আমি ভুল করেছি। হতে পারে, আমার/আপনার চোখে তাদের হাজারটা ভুল ধরা পড়ে। কিন্তু তবু নিজেকে ক্ষমাপ্রার্থী হিসেবে ই উপস্থাপন করতে হবে। প্রত্যুত্তরে যা শুনতে হবে আপনাকে তা শুনে চুপ করে থাকা কঠিন হলেও আপনার জন্য নীরবতা ই শ্রেয়। আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন৷ কেননা আপনি তর্কে বিজয়ী হবার জন্য নয়, বরং নতুনভাবে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ই আপনার এ প্রচেষ্টা।
দ্বীনে ফেরা ভাই বোনেরা পূর্বে একরকমের জীবনে অভ্যস্ত ছিলো। এখন তাদের লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এসেছে৷ পরিবারের সদস্যদের সাথে তখন তাদের সম্পর্ক বেশ জটিল হয়ে পড়ে। যেন তাদেরকে দ্বীন ধর্ম গিলিয়ে দেয়া হবে। এবং এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে তারা “নিজের নিকটতম আত্নীয়-পরিজনদেরকে ভয় দেখাও” আয়াতের কথা উল্লেখ করে। এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখবেন।
রাসূলকে (সাঃ) এরূপ নির্দেশ দিয়েছিলেন, কেননা তিনি ইতোমধ্যে ই তার পরিবারের কাছে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। সকলের সাথে তার সদ্ভাব বজায় ছিলো, প্রত্যেকের অধিকার নিয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। আপনি যদি সেরূপ শক্তিশালী সম্পর্কের অধিকারী না হন, তবে আপনার কোন কথা-ই পরিবারের কারো কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, এমনকি তা যদি ইসলামের কথা ও হয়ে থাকে। ইসলামের দাওয়াত টা অন্যসব সাধারণ কথার মতোই গুরুত্বহীন রূপে গৃহীত হবে তাদের কাছে।
আপনি অনেক লেকচার শুনছেন, প্রচুর বইপত্র পড়ছেন৷ এর প্রভাব যাচাই করবার জন্য নিজের মাঝে কতোটা পরিবর্তন এসেছে সেটি অন্যতম উপায়। এবং সর্বাধিক কার্যকরী মানদণ্ড হচ্ছে এটাই যে, আপনার নিকটজনেদের সাথে আপনার পারস্পরিক সম্পর্কের কতোটা উন্নতি হয়েছে। কারণ দিনশেষে এটি আপনার স্বীয় সত্তার একটি ইমেজ প্রতিফলিত করে।
একজন অপরিচিতের সাথে কথাবার্তা বলা বেশ সহজ। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য প্রদান ও কোন কঠিন ব্যাপার নয়৷ পর্দার আড়ালে বাস্তবজগতের যেই সম্পর্ক, সেটি রক্ষা করতে পারা ই হলো চ্যালেঞ্জিং৷ যারা আপনার চারিপাশে রয়েছেন, আপনাকে নিয়ে তাদের অনেক আশাভরসা। একইভাবে তাদের কাছে ও আপনার অনেক প্রত্যাশা রয়েছে।
আমরা প্রত্যেকে যেন সুন্দর, সুসমন্বিত পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি, যা গড়ে উঠবে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া, অন্যের প্রতি সহনশীল মনোভাব, দয়া, ক্ষমাশীলতা, যা কিছু কারো মধ্যে ভালো রয়েছে তা নিয়ে প্রশংসা করা- প্রভৃতি অনিন্দ্যসুন্দর কতিপয় বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে, আল্লাহর কাছে সে তাওফিক কামনা করছি।
বর্তমান সময়ে আমাদের মধ্যকার পারিবারিক সম্পর্ক গুলো আবদ্ধ হয়ে পড়েছে নিছক কিছু লৌকিকতার মধ্যে। আপনাকে এ বাঁধা পেরোতে হবে। সম্মানসূচক আচরণের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে হবে সকল সীমাবদ্ধতা। খোলাখুলিভাবে অনুভূতি ব্যক্ত করার অভ্যাস করতে হবে।
কখনোই নিজ থেকে অনুমান করে নিবেন না যে সে কি ভাববে। তাকে তার প্রতিক্রিয়া জানাবার সুযোগ করে দিন। আল্লাহ আমাদের পরিবারে এমন আবহ সৃষ্টির তাওফিক দিন যেখানে প্রত্যেকেই নির্দ্বিধায় তার মনের কথা জানাতে পারে। মনে করুন ইয়াকুব আলায়হিস সালামের পরিবারের কথা। তিনি তার পুত্রসন্তান ইউসুফের সাথে এতো বেশি অন্তরংগ ছিলেন যে, সে নিজের স্বপ্নের কথাও নিঃসংকোচে বলতে পেরেছিলো।
অতঃপর তিনি এটিকে নিছক স্বপ্ন বলে না উড়িয়ে দিয়ে কাছে ডেকে বসালেন। শান্ত হয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান করলেন এবং এ স্বপ্নের ইংগিত যে তার ভবিষ্যতের কল্যাণ নির্দেশ করছে, সেটিও জানালেন। আল্লাহ কুরআনে এ স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে আমাদের জন্য শিক্ষা রেখেছেন। এবং শেষে ইয়াকুব(আঃ) পুত্রকে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন সে এ স্বপ্নের কথা তার ভাইদের না জানায়।
আমাদের তো হতে হবে ঠিক এমন ই!
আয়েশা(রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“তোমাদের মধ্যে সে সর্বশ্রেষ্ঠ, যে তার পরিবারের নিকট উত্তম। এবং আমার পরিবারের কাছে আমি উত্তম।
(সুনানে তিরমিজি, হাদীস নংঃ৩৮৯৫)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের পূর্বসূরী নবী, রাসূলদের জীবন থেকে উত্তম শিক্ষা গ্রহণ করে তা নিজের জীবনে প্রতিফলিত করবার তাওফিক দান করুন।
আমীন।
মূলঃ ওস্তাদ নোমান আলী খান
ভাবানুবাদঃ সাবিহা সাবা