পরকীয়া ও ইসলাম
পরকীয়া একটি অমানবিক ক্রিয়া। বিকৃত মানসিকতার কাজ। সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো নারী-পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হতে পারে না। ইদানীং আমাদের সমাজে পরকিয়া বা বিবাহ পরবর্তী শারীরিক সম্পর্কের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব পরকীয়া সম্পর্কে প্রবাসীদের স্ত্রীরা সবচে’ বেশি লিপ্ত হচ্ছে। আজকাল খবরের কাগজ হাতে নিলেই চোখে পড়ে গৃহবধূর ধর্ষণের খবর। গবেষণায় দেখা গেছে যে, গৃহবধূ ধর্ষণের পেছনে পরকীয়া সম্পর্কের যোগসূত্র অনেক।
পরকীয়া সম্পর্ক থেকেই বেশিভাগ গৃহবধূ ধর্ষিতা হচ্ছে। পরকীয়া সম্পর্কে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, তেমনি পারিবারিক সম্পর্কে ফাটল ধরে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল দেখা দেয়। একসময় তাদের বৈবাহিক জীবনে ভাঙন সৃষ্টি হয়। পরকীয়ার বিষফল মানবজাতি দীর্ঘকাল থেকে ভোগ করে আসছে। পরকীয়ার মতো জঘন্যতম অপরাধের অসারতা নিজের বিবেককেও ধিক্কার জানায়। নিজের স্ত্রী অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হোক, কিংবা নিজের স্বামী অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে মেলামেশা করুক এটা কোনো সুস্থ বিবেকবানই মেনে নিবেন না। ইসলামও পরকীয়া-ব্যভিচারকে সমর্থন করে না।
ইসলাম মানবিক ধর্ম। ইসলাম নীতি ও আদর্শের ধর্ম। ইসলাম হালাল তরিকায় নারী-পুরুষের মেলামেশার সুযোগ দিয়েছে। বৈধ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ইসলাম পৃথিবীতে মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসলামে পরকীয়া-ব্যভিচার অবৈধ সম্পর্কে নারী-পুরুষের মেলামেশাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাইকেই চরিত্র সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “তোমরা যিনা বা ব্যভিচারের কাছেও না। এটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য আচরণ।”1
শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই এখন চরমভাবে পর্দার বিধান লঙ্ঘন হচ্ছে। ফলে কখনও দেবরের সঙ্গে, আবার কখনও পুত্রের (স্বামীর ভাইয়ের ছেলে) সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠছে। ইসলামে দেবর ও পুত্রের (স্বামীর ভাইয়ের ছেলে) কাছে যাওয়ার লাগাম টেনে ধরা হয়েছে।
হজরত উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সাবধান! তোমরা নির্জনে একাকী নারীদের কাছেও যেও না। এক আনসার সাহাবী বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.), দেবর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী? উত্তরে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য’।”2
ইসলামে শুধু অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের চূড়ান্ত রূপটাই যিনা নয়। বরং যেসব কাজ যিনার প্ররোচনা দেয় সেগুলোও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং তাও যিনা বলে গণ্য।
হাদীসে এসেছে “চোখের ব্যভিচার হল দেখা। কানের ব্যভিচার শোনা। জিহ্বার ব্যভিচার বলা। হাতের ব্যভিচার ধরা। পায়ের ব্যভিচার হাঁটা। মন কামনা করে আর লজ্জাস্থান তা সত্য বা মিথ্যায় পরিণত করে।”3
অর্থাৎ চোখ-কান-হাত-পা-জিহ্বা সবই যিনা করে- যিনার প্ররোচনা দেয়, যা পূর্ণতা পায় লজ্জাস্থানের মাধ্যমে। সুতরাং এসব অঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
পরকীয়ার মতো কর্মকান্ডে খুন-খারাবী থেকে শুরু করে আত্মহত্যার সিরিজ চলছে! ব্যক্তির ঘৃন্য কর্মকান্ডের দায়ে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনরাও পর্যন্ত সমাজে মুখ দেখাতে পারছেনা। এসব নোংরা অধঃপতিত কূকর্মগুলো পরিবার, সমাজ ও সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের কপালে ভয়ংকর এক পৈচাশিক অশ্লীলতার তীলক লাগিয়ে দিচ্ছে।
সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে ছিটকে পড়া আমাদের আধুনিক এই সমাজব্যবস্থা এটাকে প্রতিরোধ করার সক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।
ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারিণী নারীদের শাস্তি সম্পর্কে বিচারকদের সতর্ক করে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, “ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ উভয়ের প্রত্যেককে এক শত বেত্রাঘাত করো। আর আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি কোন মমত্ববোধ ও করুণা যেন তোমাদের মনের মধ্যে না জাগে যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনো। আর তাদেরকে শাস্তি দেবার সময় মু’মিনদের একটি দল যেন উপস্থিত থাকে।”4
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“অবিবাহিত নারী ও অবিবাহিত পুরুষ ব্যভিচার করলে শাস্তি: একশ বেত্রাঘাত ও এক বছরেরর জন্য নির্বাসন। বিবাহিত নারী বিবাহিত পুরুষের সাথে ব্যভিচার করলে শাস্তি একশ বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপে হত্যা।”5
“জিনাকারীরা উলংগ অবস্থায় এমন এক চুলার মধ্যে থাকবে, যার অগ্রভাগ হবে অত্যন্ত সংকীর্ণ আর নিম্নভাগ হবে প্রশস্ত, উহার তলদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে, তাদেরকে তাতে দগ্ধ করা হবে। তারা মাঝেমধ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌছে যাবে; অত:পর আগুন যখন স্তমিত হয়ে যাবে তখন তাতে তারা আবার ফিরে যাবে। আর তাদের সাথে এই আচরণ কেয়ামত পর্যন্ত করা হবে।”6
পরকিয়া প্রেম বা অন্যের বিবাহ বন্ধনে থাকা স্ত্রীর সাথে প্রেম-প্রণয়ের মাধ্যমে ব্যভিচারের লিপ্ত হওয়া আরও জঘন্য অপরাধ ও মহাপাপ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, একদা আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় পাপ কোনটি?” তিনি বললেন, “কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করা।” আমি বললাম, “এটা নিশ্চয়ই জঘন্যতম গুনাহ। তারপর কোনটি?” তিনি বললেন, “তোমার সন্তান তোমার সাথে আহারে অংশ নিবে এ আশংকায় সন্তানকে হত্যা করা।” আমি বললাম, “এরপর কোনটি?” তিনি বললে, “তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।”7
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“হে মুসলমানগণ ! তোমরা ব্যভিচার পরিত্যাগ কর। কেননা এর ছয়টি শাস্তি রয়েছে। এই মন্দ পরিণতির মধ্যে তিনটি দুনিয়াতে ও তিনটি আখেরাতে প্রকাশ পাবে।
যে তিনটি শাস্তি দুনিয়াতে হবে তা হচ্ছে :-
- তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে যাবে,
- তার আয়ুষ্কাল সংকীর্ণ হয়ে যাবে এবং
- তার দারিদ্রতা চিরস্থায়ী হবে।
আর যে তিনটি শাস্তি আখেরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে:-
জিনা বা ব্যভিচার ইসলামসহ পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থে ঘৃণিত ও জঘন্য অপরাধ। সুতরাং ধর্ষন-ব্যভিচারমুক্ত সমাজ গড়তে ধর্মীয় অনুশাসনই একমাত্র রক্ষাকবচ।
হজরত সাহল ইবনে সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার মুখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজতের জামিনদার হবে; আমি তার বেহেশতের জামিনদার হবো।”9
পরিশেষে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের গ্যারান্টির কথা স্মরণ করে দিয়ে শেষ করছি— আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
“তবে যে তওবা করে, অতঃপর ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।”10
আসুন, পরকীয়া মুক্ত জীবন গড়ি। কুরআন-হাদিস মেনে চলি ও দয়াময় আল্লাহর কাছে তওবা করে সুস্থ জীবনে ফিরে আসি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
- সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত- ৩২ ↩︎
- সহিহ বুখারী- ৫২৩২, সহিহ মুসলিম- ২১৭২, ২৪৪৫, ৫৫৬৭, ৫৫৬৯, সুনানে আহমাদ- ১৭৩৫২, জামে তিরমিজি- ১১৭১ ↩︎
- সহীহ মুসলিম- ২৬৫৭ ↩︎
- সূরা আন্-নূর, আয়াত- ২ ↩︎
- সহিহ বুখারী- ৬৩৪৩, ৬৩৪৫ থেকে ৪৩৪৮ (আ.প্র.), সহিহ বুখারী- ৬৩৫৮ থেকে ৪৩৬১ (ই.ফা.), সহিহ বুখারী- ৬৩৬৫ (ই.সে.), সহিহ মুসলিম- ৪২৬৭ (ই.ফা.), সহিহ মুসলিম- ৪২৬৮ (ই.সে.), সহিহ মুসলিম- ১৬৯১, আহমাদ- ১৪৪৬৯ ↩︎
- সহিহ বুখারী- ৭০৪৭, সহিহ বুখারী- ৬৫৫৮ (আ প্র.), সহিহ বুখারী- ৬৫৭১ (ই. ফা. ), সহিহ মুসলিম- ২২৭৫, আহমাদ- ২০১১৫ ↩︎
- সূরা আল ফুরকান, আয়াত- ৬৮, ৬৯, সহিহ বুখারী- ৪২০৭, ৪৪৭৭, ৬৮৬১, ৭৫৩২, সহিহ মুসলিম- ৮৬, ২৬৭, ২৬৮, সুনানে আবু দাউদ- ২৩১০, তিরমিযী, নাসাঈ, আহমদ ↩︎
- সুনানে বায়হাকী- ৫৬৪ ↩︎
- সহিহ বুখারী- ৭৬৫৮ ↩︎
- সূরা আল ফুরকান- ৭০ ↩︎