প্রত্যেক ইবাদত শুদ্ধ হওয়ার জন্যই নিয়ত শর্ত। নামাজের ন্যায় মহান ইবাদতের শুরুতেও নিয়ত আবশ্যক। আর নিয়ত হলো অন্তরে কোনো কাজের সংকল্প করা। আর তা শুধু অন্তরের কাজ, তাই যেকোনো ইবাদতের নিয়তের ক্ষেত্রেই আরবি বাংলা শব্দ উচ্চারণ নিষ্প্রয়োজন।
নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা স্পষ্ট সুন্নাহ বিরোধী কাজ
নিয়ত না হলে কোন ইবাদতই বিশুদ্ধ হয় না। আরবী নিয়ত শব্দের অর্থ হল মনে ইচ্ছা পোষণ করা। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল যে নামাযই হোক অথবা যে ইবাদতই হোক, মনে মনে এর নিয়ত করতে হবে। আরবি বা বাংলায় মুখে এর নিয়ত উচ্চারণ করা যাবে না। কারণ এটি একটি বিদআত।
কেউ কেউ “নাওয়াইতুয়ান” মুখে উচ্চারণ করে পড়ে থাকেন এবং অনেক সময় কিছু মূর্খ লোক যারা সমাজে আলেমের বেশ ধরে থাকেন তারাও এটা পড়তে বলে। অথচ হাদিসে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোথাও পাওয়া যাবে না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করেছেন বা করতে বলেছেন। বরং তিনি মনে মনে নিয়ত করেছেন।
আর “নাওয়াইতুয়ান” নামক এই আরবী বাক্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওফাতের অনেক বছর পর মানুষের দ্বারা নতুন আবিষ্কৃত বাক্য। সহীহ হাদীস তো দূরের কথা কোন যঈফ হাদীসেও মুখে নিয়ত উচ্চারণের কথা বলা নেই। তাই ইসলামের শরীয়াতের বিধান হল মনে মনে নিয়ত করা। [সহীহুল বুখারী, ১/১ ।। সহীহ মুসলিম, ৪৬]
নিয়ত সম্পর্কে পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় আলেমদের মন্তব্যঃ
১) মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ত্রিশ হাজার ওয়াক্ত নামায আদায় করেছেন। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই কথা বর্ণিত নেই যে, আমি অমুক অমুক ওয়াক্ত নামাযের নিয়ত করছি। সুতরাং মুখে নিয়ত উচ্চারণ না করাটাই সুন্নাত। জেনে রাখুন, শব্দ উচ্চারণ করে মুখে নিয়ত করা জায়েয নয়। কারণ এটা বিদআত। সুতরাং যে কাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেন নি তা যে করে সে বিদআতি। [দেখুনঃ মিরকাত, ১/৩৬-৩৭]
২) আল্লামা ইবনুল হুমাম হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ হাদীসের বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ ও যঈফ কোন সনদেও এই কথা প্রমাণিত নেই যে, তিনি নামায আরাম্ভ করার সময় বলতেন যে, আমি এই এই নামায আদায় করেছি। কোন সাহাবী এবং তাবেঈ থেকেও প্রমাণিত নেই। বরং এই কথা বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায আরম্ভের সময় কেবল শুধু তাকবীর বলতেন। তাই মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদআত।
[ফাতহুল কাদীর, ১/৩৮৬ ।। কাবীরী, পৃষ্ঠা ২৫২]
৩) আব্দুল হাই লাখনৌভী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদআত।
[দেখুনঃ সিরাতুল মুস্তাকীম]
৪) আবদুল হক দেহলভী হানাফী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেনঃ মুখে নিয়ত পাঠ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবা কেরাম, তাবেঈ কারো হতেই কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন শুধু “আল্লাহু আকবার” বলতেন। এর পূর্বে মুখে নিয়ত পড়ার কোন শব্দ হাদীসে নেই। সে জন্য মুহাদ্দিসগণ মুখে নিয়ত পাঠ করাকে বিদআত ও মাকরূহ বলেছেন।
[দেখুনঃ ফাতহুল কাদীর ।। মাদারিজুন নাবুওয়্যাত]
৫) আল্লামা শাফী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ চার ইমাম থেকেও মুখে নিয়ত পড়া প্রমাণিত নেই।
[শামী, ১/৩৮৬ ।। বাহরূর রায়িক, ১/২৭৮]
৬) মালিকী মাযহাব মতে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা মাকরূহ।
[দেখুনঃ মিরকাত, ১/৩৬]
৭) হাম্বলী মাযহাব মতে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা বিদআত।
[দেখুনঃ মিরকাত, ১/৩৬]
৮) হাফিয ইবনুল ক্বাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ মুখে নিয়ত পাঠ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ কারো হতেই কোন প্রমান পাওয়া যায় না। মুখে পাঠের এই পদ্ধতি শয়তানের একটি কুমন্ত্রণা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন শুধু “আল্লাহু আকবার” বলতেন। আর আগে কিছু বলতেন না। সুতরাং মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা বিদআত। চার ইমামও এরূপ নিয়তনামা পড়াকে পছন্দ করেন নি।
[ইগাসাতুল লুহফান, ১/১৩৬ ।। যাদুল মাআদ, ১/৫১]
৯) সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আরবী নিয়ত শব্দের অর্থ হল মনে ইচ্ছা পোষণ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটা প্রমাণিত নেই। না প্রমাণিত আছে কোন সাহাবী এবং তাবেঈ থেকেও। তাই মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদআত।
[ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, ৩৩৯-৩৪০ পৃষ্ঠা]
১০) ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ শব্দ করে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পাঠ করা নিকৃষ্ট বিদআত। যে ব্যক্তি একে উত্তম বা মুস্তাহাব বলবে তাকে তওবা করার নির্দেশ দিতে হবে। যদি সে তওবা করে নেয় তাহলে ভাল, অন্যথায় তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
[মাজমুআহ ফাতাওয়াহ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ]
১১) মদীনার মসজিদে নববীর খতীব এবং মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ আল্লামা আবু বাকার জাবির আল জাযায়েরী তার রচিত গ্রন্থে লিখেছেনঃ নামাযী যে নামাযের জন্য দাঁড়াবে, মনে মনে তার নিয়ত করা আবশ্যক। নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের বিরোধী অর্থাৎ বিদআত। চার ইমাম সহ তার কোন অন্ধ অনুসারীও মুখে মুখে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে বলেন নি।
[পবিত্রতা অর্জন ও নামায আদায়ের পদ্ধতি, পৃষ্ঠা ২০]
(১২) শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহিমাহুল্লাহ তার নিজ রচিত গ্রন্থে লিখেছেনঃ মুখে নিয়ত করা যাবে না। কেননা শরীয়তে এরূপ করার হুকুম নেই বরং এটা একটি বিদআত। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা সাহাবীগণ মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করেন নাই।
[নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায পড়ার পদ্ধতি, পৃষ্ঠা ৫]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা সব মুসলিম ভাই ও বোনদের বিদআত থেকে বেশি করে বাঁচার ও বিদআত মুক্ত ইবাদাত করার তাওফীক দিন।
ওমা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ,
আল্লাহুম্মা আমিন।
সম্মানিত ভাই ও বোনেরা নিম্নে কিছু শাইখ, মুফতি ও বিজ্ঞ আলেম এর লেকচার দেওয়া হলো, তা যদি কষ্ট করে দেখেন তাহলে বিস্তারিত আরো বেশি বুঝতে পারবেন ও সমাধান পাবেন, ইনশাআল্লাহ হুল আজিজ (আল্লাহ যদি চান, তিনিতো পরাক্রমশালী)।
https://youtu.be/AF0cRLTsT1g
সংগৃহীত
জুবায়ের আহমেদ