উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জন্ম তাদের নানাবাড়িতে। হুমায়ূন আহমেদ, শামসুর রাহমান, সুকান্ত ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন সহ অনেকেই নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশে বিখ্যাত আলেম, ‘মাসিক মদীনা’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খানও কিশোরগঞ্জে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
আজ সকালে উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর (রাহিমাহুল্লাহ) জীবনী পড়তে গিয়ে দেখলাম তিনিও জন্মগ্রহণ করেন তাঁর নানাবাড়িতে।
আমাদের পরিবারে আমরা চার ভাই-বোন। প্রথম তিন ভাই-বোনের জন্ম দাদার বাড়িতে, সবার ছোটো বোনের জন্ম নানাবাড়িতে। নানাবাড়ির আত্মীয়রা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলে যাবার সময় আমরা বলি- “আপনাদের বাড়ির লোককে নিয়ে যান!” ছোটো বোনকে ‘নানা বাড়ির লোক’ বলে ক্ষেপিয়ে আমরা মজা পাই। অবশ্য হবার কথা ছিলো উল্টো।
উপমহাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণত প্রথম সন্তানের জন্ম হয় নানাবাড়িতে। এটার পেছনে সমাজের দীর্ঘদিনের প্রথা যেমন জড়িত, তেমনি কিছু যুক্তিও আছে। মোটাদাগে সেসব যুক্তিগুলো আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়।
ইসলামের নবীগণের মধ্যে একজন নবী তাঁর নানাবাড়ি/মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হলেন ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)। শুধু তিনি একা নন, তাঁর বাকি দশ ভাইয়ের জন্ম হয় তাঁর নানাবাড়িতে। তাঁর ভাইদের মধ্যে শুধু বেনিয়ামিনের জন্ম হয় তাঁর দাদাবাড়িতে।
মূসা (আলাইহিস সালাম) মাদায়েনে কয়েকবছর থাকেন, সেখানে গিয়ে বিয়ে করেন। তাঁর সন্তানদেরও জন্ম হয় তাদের নানাবাড়িতে।
গ্রাম-মফস্বলে জন্ম নেয়া কেউ ছোটোবেলায় কোথাও বেড়াতে যাবার কথা উঠলে সবার আগে নানাবাড়িতে যেতে চাইতো। ঈদের ছুটি, পূজার ছুটি, গ্রীষ্মকালীন অবকাশে নানাবাড়ি না গেলে ছুটিকে যেনো আর ‘ছুটি’ মনে হয় না।
স্কুল-বয়সে সামার ভেকেশন বা গ্রীষ্মকালীন ছুটিকে আমরা ডাকতাম ‘আম-কাঁঠলীর বন্ধ’। প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষেই বায়না ধরতাম নানাবাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। বাকিরা চলে গেছে, আমরা কবে যাবো?
নানাবাড়ির সব আম-কাঁঠাল শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ছোটোবেলায় পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘মামার বাড়ি’ নামে যে ছড়াটি পড়েছিলাম, সেটা ছিলো সংক্ষিপ্ত ভার্সন। মূল ছড়াটি একটু বড়ো। সেই ছড়ার মাঝখানের কয়েক লাইন এমন:
“আম-কাঁঠালের বনের ধারে
মামা-বাড়ির ঘর,
আকাশ হতে জোছনা-কুসুম
ঝরে মাথার পর।”
গ্রীষ্মকালে যেকোনো জায়গায় গিয়ে আম-কাঁঠাল খাওয়া যায়। কিন্তু, কবি বলতে চান আম খাওয়াতেই কেবল সুখ না, সুখ হলো আম কুড়ানোতে। ছোটোবেলার সুখ-সন্ধান ছিলো অন্যরকম। রোদের মধ্যে ফড়িং ধরা, দুপুরবেলা গাছে চড়া, পুকুর-নদীতে ঝাঁপ দেবার মধ্যে আমরা আনন্দ খুঁজতাম। যারা আরেকজনের গাছের ফল চুরি করতো, সেটা যে ফল খাবার উদ্দেশ্যে হতো, এমন না। টানটান উত্তেজনার মধ্যে ফল চুরিটাই তখন উপভোগ করা হতো।
অনেকেই নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেননি। তারচেয়েও দুঃখের হলো, অনেকেই তার নানা-নানী পাননি। জন্মের পূর্বেই হয়তো তারা মারা গেছেন। যাদের এমন আফসোস আছে, তারা এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে- নবিজীরও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনটা হয়েছিলো। তিনি তাঁর নানা-নানীকে পাননি।
নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নানার নাম ছিলো ওয়াহাব ইবনে আবদে মানাফ, নানীর নাম ছিলো বারীরাহ বিনতে আব্দুল উজ্জাহ। নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মের পূর্বেই তারা ইন্তেকাল করেন। ওয়াহাব ইবনে আবদে মানাফের কোনো ছেলে ছিলো না। ফলে, নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেমন ‘নানাবাড়ি’ পাননি, তেমনি পাননি ‘মামাবাড়ি’।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে নানাবাড়ি না পেলেও তিনি কিন্তু নানা হোন। আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) –এর প্রথম সন্তানের জন্ম হলে তিনি তাঁর নাম রাখেন ‘হারব’। হারব মানে যুদ্ধ। আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নিজে ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা, সেই হিশেবে যুদ্ধ নামটি তিনি পছন্দ করলেন। কিন্তু, নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন নাতির জন্য এমন নাম পছন্দ করলেন না। তিনি নাম রাখেন- ‘হাসান’। এর অর্থ সুন্দর, সুদর্শন।
আলীর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দ্বিতীয় ছেলের জন্ম হলো। আবারো তিনি ছেলের নাম রাখলেন ‘হারব’। দ্বিতীয়বারের মতো নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাতির নাম পাল্টালেন। এই নাতির নাম রাখলেন- ‘হুসাইন’। হুসাইন মানে সুদর্শন পিচ্চি।
আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তৃতীয়বারের মতো পুত্র সন্তানের বাবা হলেন। ‘হারব’ নামের প্রতি তাঁর আগ্রহ তখনো ভাটা পড়েনি। তৃতীয়বারের মতো তিনি তাঁর আরেক পুত্রের নাম রাখেন ‘হারব’। এবারও নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাতির নাম পাল্টালেন। নতুন নাম রাখলেন- ‘মুহসিন’। মুহসিন মানে সুন্দর আচরণকারী। মুহসিন ছোটোবেলায় ইন্তেকাল করেন।
হাসান-হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) ছিলেন নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কলিজার টুকরো। তিনি বলতেন, “হাসান-হুসাইন হলো দুনিয়াতে আমার দুটো সুগন্ধী ফুল।”
আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)ও নানা হয়েছিলেন। তাঁর নাতি ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। নানা-নাতী দুজনই সাহাবী। সম্ভবত এমন সৌভাগ্য আর কারো হয়নি।
বিটিভিতে জনপ্রিয় টিভি শো ‘ইত্যাদি’র সবচেয়ে মজার পার্ট ছিলো নানা-নাতির পার্ট। অমল বোসের পার্ট ছিলো নানা হিশেবে, শওকত আলী তালুকদারের পার্ট নাতি হিশেবে। কয়েকবছর আগে ‘নানা’ অমল বোস মারা যান। প্রথম আলোর একটি সাক্ষাৎকারে শওকত আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, তিনি কেনো ‘নাতি’র পার্ট ছাড়া আর কিছুতে অভিনয় করেন না? জবাবে তিনি বলেছিলেন, তিনি নাতি হয়েই থাকতে চান!
আমাদের এদিকে বিয়ের আগে একেবারে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের জন্য কাপড় কেনা হয়। দাদা, নানা, দাদী-নানী থাকলে তাদের জন্যও কাপড় কেনা হয়। আমার বিয়ের কেনাকাটা করে বাসায় ফিরি। নানার জন্য কিনেছিলাম একটি সাদা পাঞ্জাবি। সেই রাতেই ফোন আসে- নানা ইন্তেকাল করেছেন!
আমার কেনা সাদা পাঞ্জাবি নানা পরতে পারেননি। পরদিন তাঁকে কাফনের সাদা কাপড় পরিয়ে রেখে এসেছিলাম কবরে! প্রায়ই তাঁর কথা ভাবি, তাঁকে স্বপ্নে দেখি।
অনেকেই নানা-নানী পাননি, অনেকেই নানা-নানী হারিয়েছেন। আসুন, অন্তত একবার তাদের মাগফিরাতের জন্য মনখুলে দু’আ করি।