নবিজীর (সা:) দুধ-মা ছিলেন যিনি

মক্কায় কয়েকজন ধাত্রী এসেছেন। তারা পেশাদার ধাত্রী। বেশিরভাগই বনু সা’দ গোত্রের। মক্কার শিশুদেরকে দুধপান করিয়ে তারা জীবিকার্জন করেন। ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিশুদের পাবার জন্য তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লাগে। সবাই চায় ধনী পরিবারের সন্তানের ধাত্রী হতে। এতে অনেক টাকা পাওয়া যায়।

হালিমা আস-সাদিয়া নামের একজন ধাত্রী একই উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন। তাঁর সাথে আছেন তাঁর স্বামী আল-হারিস। দুর্ভিক্ষের বছর তারা এসেছেন। দুর্ভিক্ষের মধ্যে যদি ধনী পরিবারের একজন সন্তানকে পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো তাদের পরিবারে সুদিন আসতে পারে। তাঁর এবং তাঁর পরিবার বেশ কয়েকটি সমস্যায় আছে।

তাঁর সাথের উটটি বেশ দুর্বল। ধীরে ধীরে চলে।
উটটি দুধ দেয় না।
তাঁর সন্তানরা ক্ষুধার কারণে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে।

মক্কার কুরাইশ বংশের এক ইয়াতিম শিশুকে উপস্থাপন করা হলো। ১১ জন ধাত্রীর কারোরই তাঁর প্রতি আগ্রহ নেই। আগ্রহ থাকবে কিভাবে? ছেলেটি ইয়াতিম। তাঁকে দুধপান করিয়ে ঠিকমতো বিনিময় পাওয়া যাবে?
এই শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
১০ জন ধাত্রী মক্কার ১০ জন সন্তান পেলো। তারা বেশ ধনী পরিবারের। কিন্তু, হালিমা আস-সাদিয়া কোনো সন্তান পেলেন না। দুর্ভিক্ষের মধ্যে এতোদূর আশা নিয়ে এলেন, খালিহাতে ফিরে যাবেন?

স্বামীর সাথে পরামর্শ করলেন হালিমা। জেদ ধরে বললেন- আমি খালি হাতে ফিরে যাবো না। খালি হাতে ফিরবেন না আবার মক্কার ঐ ইয়াতিম শিশুকেও নিবেন না; যেকোনো একটি তো করতে হবে। স্বামীকে বললেন, “আমি তাহলে ঐ ইয়াতিম শিশুকে নিই?” স্বামী বললেন, “হ্যাঁ, নাও না। হয়তোবা সে আমাদের জন্য বরকতময় হবে।”

হালিমা আস-সাদিয়া মক্কার ইয়াতিম শিশুকে নিয়ে নিজেদের উটের কাছে গেলেন। হালিমা শিশুকে দুধ খাওয়ালেন, সাথে নিজের পুত্র আব্দুল্লাহকেও। তাঁর নিজের কাছে একধরণের বরকতময় অনুভূতি কাজ করছিলো। যে উট দুধ দিতো না, সেই উটের ওলান দুধে পরিপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রী দুজন দুধপান করলেন। উটটি এতো দূর্বল ছিলো যে, আস্তে আস্তে চলতো।
কিন্তু, ঐ ইয়াতিম শিশুকে উটে উঠানোর পর উটের গতি বেড়ে গেলো। উটটি বাকি ১০ জন ধাত্রীর উটের আগে ছুটলো।

বাকিরা তো অবাক। অবাক হালিমা ও আল-হারিস। বাকিরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি আগের উট নাকি নতুন কোনো উট?” তারা জবাব দিলেন, “আগের উটই তো।”

এটা শুনে বাকিদের চক্ষু চড়কগাছ। তারা মনে করলো, কোনো ম্যাজিক আছে হয়তো! হালিমা আস-সাদিয়া যে বরকতময় শিশুকে নিয়ে এসেছেন, তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।

হালিমার ছাগল-ভেড়া যে চারণভূমিতে চরতে যেতো, সেখান থেকে তারা পেটভরে খেয়ে আসতো। ছাগলগুলো অনেক দুধ দিতো। অথচ এমনটা আগে কখনো হতো না। এসব দেখে বাকিরা বলাবলি করতো, হালিমার ছাগলগুলো যেখানে চরে বেড়ায় তোমাদের ছাগলগুলোও সেখানে নিয়ে যাও।

হালিমার ঘরে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বড়ো হতে লাগলেন। তাঁর দুধভাই ছিলেন আব্দুল্লাহ। দুই বছর পর তাঁকে ফিরিয়ে দেবার সময় এলো। হালিমা মক্কায় গিয়ে আমিনার কাছে ছেলেকে নিয়ে গেলেন। মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –এর বয়স তখন ২ বছর হলেও তাঁকে দেখতে ৪ বছর বয়সী মনে হচ্ছিলো। হালিমা এই সুযোগে আমিনার কাছে একটি অনুরোধ করেন। তিনি আরো কিছু সময় মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –কে তাঁর কাছে রাখতে চাচ্ছেন। আমিনা অনুমতি দেন।

দ্বিতীয়বারের মতো মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হালিমার পরিবারে আসেন। এই বার একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন খেলাধুলা করছিলেন, তখন জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) এসে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করেন। তাঁর হৃদয়ের কালো অংশটি ধুয়ে দেন। আবার সবকিছু ঠিক করে দেন।

সবাই এমন দৃশ্য দেখে ভাবলো মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –কে বুঝি হত্যা করা হয়েছে! তারা হালিমার কাছে গিয়ে বললো। এটা শুনে তিনি বেশ আতঙ্কিত হলেন এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –এর ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে রাজী ছিলেন না। তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের মায়ের কাছে যতোদিন না থাকেন, তারচেয়ে বেশিদিন থাকেন হালিমার কাছে। তিনি তাঁর দুধ-মাকে স্মরণ করতেন। খাদিজার (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সাথে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –এর বিয়ে হলে খাদিজা (রা:) তাঁর স্বামীর দুধ-মাকে সম্মান করতেন, তাঁর খোঁজখবর নিতেন।

একবার হালিমা আস-সাদিয়া মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পরিবারে আসেন। যাবার সময় খাদিজা (রা:) তাঁকে ৪০ টি ছাগল, ১ টি উট এবং মূল্যবান উপহার সামগ্রী দেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলাম প্রচার শুরু করেন। হালিমা বুঝতে পারেন তিনি কাকে দুধপান করিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন, তিনি ছিলেন একজন নবীর দুধ-মা। হালিমা আস-সাদিয়া, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুধ-মা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাদিয়াল্লাহু আনহা।

নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুধ-মা ছিলেন যিনি

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version