Writing

নতুন পরিচয়

ধীরগতিতে এক পা দু’ পা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আবদুল্লাহ। চিরকালের জন্য পরিবারকে ছেড়ে আজানা গন্তব্যের পানে পথ চলতে হবে- কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন জানি হাহাকার করছে, গলার ভেতর দলা পাকিয়ে আসছে। সে চায় না তার পরিবার থেকে দূরে যেতে। সে যে তাদের ছেড়ে এক মুহূর্তও ভালো থাকতে পারবে না। কিন্তু আজ তাকে যেতেই হবে, আর কোন পথ খোলা নেই তার সামনে।

আবদুল্লাহ, পূর্বের নাম ছিল রমেশ। কিছুদিন হয় ইসলামের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে। এর পেছনে রয়েছে এক কষ্টময় ইতিহাস।
তার বন্ধুমহলের সবচেয়ে পরিচিত মুখ আবদুর রহমান তাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলো। সে তাকে বুঝিয়েছে- আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং একত্ববাদে বিশ্বাস না করলে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। সে তাকে বুঝিয়েছে কিভাবে সিজদাহে্র মাধ্যমে রবের সবচেয়ে নিকটে যাওয়া যায়, কিভাবে সকল অশান্তি, সকল কষ্ট সিজদাতে মাথা দিলেই গায়েব হয়ে যায়৷

তার খুব ভালো করেই মনে আছে কালেমা পড়ার দিনের কথা। সেদিন কিভাবে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো সে, সিজদাতে লুটিয়ে পড়ে কিভাবে রবের নিকট ক্ষমা চেয়েছিলো, কিভাবে রবের শুকরিয়া আদায় করেছিলো। সেও এখন থেকে সালাত আদায় করতে পারবে, রোজা রাখতে পারবে, হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিশেবে স্বীকৃতি দিতে পারবে- কথাগুলো ভাবতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছিলো সে।
কিন্তু তার পরিবার তাকে কিছুতেই মেনে নেয় নি। তারা ছিল কট্টর হিন্দু। তার বাবার এক কথা, যদি তাদের সাথে থাকতে হয় তবে তাকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দু ধর্ম গ্রহন করতে হবে। কিন্তু সে তা কিছুতেই করতে পারবে না। এতোটা বছর অবাধ্যতা করে যে ভুল সে করেছে তা আর পূনরায় করতে চায় না। তাই সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শেষবারের মতো সে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়েছিলো। তার বাবা তার দিকে ফিরেও তাকায় নি কিন্তু মা খুব কেঁদেছিল। সকলের মায়া ত্যাগ করে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিলো তার। খুব কেঁদেছিলো সে।

অজানা গন্তব্যের পানে পা বাড়াতে থাকে আবদুল্লাহ। বাড়ি থেকে আসার সময় অল্পকিছু টাকা সাথে করে নিয়ে এসেছিলো যা দিয়ে তার যাতায়াত খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হবে। বাসস্ট্যান্ডে এসে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাস চলে আসায় তাতে করে রওনা হয় শহরের দিকে।
বাস থেকে নেমে ক্লান্ত পায়ে এগোতে থাকে সে। এ শহরের সবকিছুই যে অচেনা তার। কোথায় গিয়ে রাতটুকু পার করবে এই চিন্তায় মাথা ঝিম ধরে গিয়েছিলো তার। এদিকে অনেকক্ষণ হয় পেটে কিছু পড়ে নি তাই শরীরটাও নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। অনেক কষ্টে শরীরটাকে টেনে মসজিদের সামনে আসতেই বসে পড়লো সে। আর এগোতে পারছে না। রাতটা কোনমতে এখানে পার করে সকালে একটা নিশ্চিত ঠিকানার সন্ধানে বেড়িয়ে পড়তে হবে।

এদিকে সকাল হতেই আবদুল্লাহর গ্রামের বাড়ির আশেপাশে সব জানাজানি হয়ে যায়। সবাই তার ইসলাম গ্রহনের কথা জানতে পেরে তার পরিবারের উপর হামলা করে ও তাদের গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে। তার বাবা-মা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে পাশের গ্রামের একটি ছোট কুঁড়ে ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
কুঁড়ে ঘরে থাকতো এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দম্পতি। নিজেদের খাবার জোগাড় করতেই বেশ বেগ পেতে হতো তাদের৷ এখন বাড়তি দুজন লোক চলে আসায় তাদের কিভাবে খাওয়াবে এই নিয়ে চিন্তায় নিমগ্ন তারা। এমন সময় স্ত্রী বলে উঠলো-

“চিন্তা কইরো না। রব একটা না একটা ব্যবস্থা কইরা দিবো। তুমি খাবারের খোঁজে বাহির হও। আমি তার সাথে কথা বলি গিয়া।”
তাদের কথোপকথন আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিলো আবদুল্লাহর বাবা-মা। কিন্তু তারা বুঝতে পারে নি বৃদ্ধা কার সাথে কথা বলার কথা বলছিলো। ব্যাপারটা বোঝার জন্য পর্দার আড়াল থেকো উঁকি দিয়েছিল আবদুল্লাহর মা। তিনি দেখতে পেলেন বৃদ্ধা মহিলা সেজদায় লুটিয়ে পড়েছে। ফিসফিস করে কি যেন বলছেন আর অশ্রু ঝরাচ্ছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বৃদ্ধা মহিলা নামাজ পড়ছেন। কিন্তু তিনি তো বললেন কার সাথে জানি কথা বলবেন!

কিছুক্ষণ পর খাবার হাতে হাজির হয় বৃদ্ধ লোকটি। চোখেমুখে কি হাসির ঝলকানি তার! দরজার বাইরে থেকেই বৃদ্ধাকে ডাকতে শুরু করলেন।
“ও আমেনার মা…. কই গেলা তুমি! শিগগির আসো।”
আমেনার মা দৌড়ে আসে দরজার পানে। চেয়ে দেখে স্বামী প্যাকেট হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি সালাম দিয়ে তার স্বামীর হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে তাকে ভেতরে এসে বসতে বললেন।

বাহিরে কাঠফাটা রোদ। হেঁটে এসে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন তিনি। তাই এক গ্লাস পানি তার হাতে দিয়ে বললেন
“তাড়াতাড়ি পানিডা খাইয়া লও দেহি।”
স্বামীর হাতে গ্লাস দিয়ে তিনি পাখা হাতে তার পাশে বসে পড়লেন বাতাস করার জন্য।
“বুঝলা আমেনার মা। আমি ভাবি নাই এই রোইদে দিয়া আমি খাবার আনতে পারমু কিন্তু কেমনে যে পাইয়া গেলাম আল্লাহই ভালা জানে।”
“তুমি যাওয়ার পরখান দিয়াই আমি নামাজে খাঁড়াইছি, আল্লাহর কাছে চাইছি। তিনি কি আমাগো খালি হাতে ফিরাইয়া দিতে পারে, কও! তিনিই আমাগো ব্যবস্থা কইরা দিসেন।”
কথাগুলো দূর থেকে শুনেছেন আবদুল্লাহর মা৷ এতক্ষণে তিনি কথা বলার রহস্য খুঁজে পেলেন!

বেশ অনেকদিন হয়ে গিয়েছে আবদুল্লাহ এর বাবা-মা গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে। নিজের বাড়ির জন্য বড্ড মায়া হয় তাদের। কিন্তু এখানেও তারা বেশ ভাল আছে। হয়তো থাকা-খাওয়া নিয়ে কিছুটা কষ্ট পোহাতে হয় কিন্তু মানসিকভাবে তারা অনেকটা শান্তিতে আছে।
বৃদ্ধ দম্পতি নিজেরা না খেয়ে থাকলেও তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। নিজেদেরকে খুব বোঝা মনে হয় তাদের উপর। যদিও তারা কোনদিন তাদের এরূপ বলে নি। তারা যে তাদের আপন কেউ নয় এমনকি তাদের ধর্মও যে এক নয় তা ওই দম্পতি কিছুতেই বুঝতে দেয় নি। তারা তাঁদেরকে নিজের পরিবারের লোকজনের মতো করে আদর-আপ্যায়ন করেছে।

তাদের সাথে থাকতে থাকতে আবদুল্লাহর মা-বাবা ইসলামের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে লাগলেন। একজন মুসলিমের সর্বাবস্থায় রবের প্রতি ভরসার প্রতীক তাদের সামনে স্পষ্ট ছিল। এতোদিনে তারা বুঝতে পারলেন কেন তার ছেলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলো এবং কেন তাদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিল।

কিছুদিন পর সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দম্পতির হাত ধরেই তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে৷
এর মাঝে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তারা আবদুল্লাহর অনেক খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু কোথায়ও তার সন্ধান মেলেনি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তার ব্যক্তিগত মোবাইলটাও সে সাথে নিয়ে যায়নি। তাহলে নাহয় যোগাযোগ করা যেতো। তাছাড়া তারাও তো গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে, আবদুল্লাহও যদি তাদের খোঁজ করে তবেও তো কোথায়ও সন্ধান মিলবে না তাদের।

এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে বাবা-মায়ের কাছে বেশ কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছিল আবদুল্লাহ কিন্তু একটিরও জবাব সে পায়নি। জবাব পাবেই বা কি করে তাদের বাবা-মা তো এখন আর পূর্বের আবাস্থলে থাকেনই না! তবে এটা তো জানা ছিল না তার। তাই সে চিঠির উত্তর না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু এসে জানতে পারলো তারা এখন আর এ গ্রামে থাকেন না।
আবদুল্লাহ এখন একজন মাদরাসার ছাত্র। দ্বীন সম্পর্কে বেশ ভাল বুঝ আছে তার, আলহাদুলিল্লাহ। তার খুব আশা ছিল তার বাবা-মায়ের সামনে প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় দাঁড়াবে। কিন্তু তার এ স্বপ্নটা অপূর্ণই রয়ে গেলো। সে হতাশ হয়ে শহরের পানে রওনা হলো।

এদিকে কোন এক মাধ্যমে আবদুল্লাহর বাবা জানতে পেরেছিল যে, আবদুল্লাহ এসেছিল তাদের সাথে দেখা করতে। তাঁদের খোঁজ না পেয়ে সে আবার শহরে চলে গিয়েছে। কিন্তু শহরের কোথায় সে থাকে এটা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে নি।
সংবাদটি শোনার পরদিনই আবদুল্লাহর বাবা-মা শহরের পথে যাত্রা শুরু করে।

দিনটি ছিল শুক্রবার। পথিমধ্যে জুমার আজান শুনতে পেয়েছিল তারা। বাসও ঠিক সময় মতোই গন্তব্যে পৌঁছেছিলো। বাস থেকে নেমে আগে সলাত আদায় করতে মসজিদের পানে চলে যায় আবদুল্লাহর বাবা। পাশে মহিলাদেরও নামাজের ব্যবস্থা ছিল। তার মা সেখানেই জোহরের সলাতের জন্য গেলো।
সলাত আদায় করে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে তবে আবদুল্লাহর খোঁজে বের হবে- আসতে আসতে এমনটাই পরিকল্পনা করেছিল তারা। সলাত আদায় শেষে মসজিদ থেকে বের হতে যাবে এমন সময় একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে এলো তার।

পরিচিত কন্ঠটি সবাইকে বসার জন্য অনুরোধ করলো। সবাই আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো। সে তার কথা শুরু করলো। প্রথমে কতক্ষণ দ্বীন নিয়ে আলোচনা করলো। সবিশেষে কেউ একজন তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে বলতে লাগলো
“আমি আবদুল্লাহ। একজন নওমুসলিম। দু’বছর হলো আমি রবের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছি।”

আবদুল্লাহ! নামটি শোনার পর চমকে উঠলো তার বাবা। ভাল করে চেহারার পানে চেয়ে দেখে এ আর কেউ নয় তার নিজের ছেলে আবদুল্লাহ! মা শা আল্লাহ সে আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে! ভীড় ঠেলে আবদুল্লাহর পানে দৌড়ে যায় সে। গিয়ে শক্ত করে বুকের সঙ্গে বুক মিলিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
আবদুল্লাহ কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। “কে এই লোক! তাকেই বা কেন এভাবে এসে জড়িয়ে ধরলো!” প্রশ্নগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

এমনসময় তার সকল উদ্বেগ-উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে তিনি বলে উঠেন,
“আমি তোর বাবা রে। আমাকে চিনতে পারিস নি?”
আমার বাবা! সত্যি তুমি আমার বাবা! কথাগুলো বলার সময় তার চোখদুটো দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না তার বাবাও এখন একজন মুসলিম।
সেদিন তাদের সাথে পুরো মসজিদের মুসল্লীরা কেঁদেছিল। এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ হয়েছিল তাদের।

লিখেছেন

Picture of ফারিহা আনজুম সানজি

ফারিহা আনজুম সানজি

লেখা পড়া করছি অনার্স এবং পাশাপাশি আইওএম এ আলিম প্রিপেরটরি কোর্স করতেছি।
স্পষ্টভাষী • তলিবিল ইলম • দাঈ ইলাল্লাহ

All Posts

লেখা পড়া করছি অনার্স এবং পাশাপাশি আইওএম এ আলিম প্রিপেরটরি কোর্স করতেছি।

স্পষ্টভাষী • তলিবিল ইলম • দাঈ ইলাল্লাহ

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture