একজন মুসলমানের বিয়েতে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্দেশিত অপরিহার্য প্রদেয় স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রী যে অর্থ-সম্পদ পেয়ে থাকে তাকেই দেনমোহর বলে। বিয়ের সময় স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করা স্বামীর ওপর ফরজ।
আল্লাহ তা’আলা বলেন –
“আর তোমাদের স্ত্রীদের তাদের দেনমোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। অবশ্য স্ত্রী চাইলে দেনমোহর কিছু অংশ কিংবা সম্পূর্ণ অংশ ছেড়ে দিতে পারে।
[সূরা আন-নিসাঃ ৪]
তবে এ ব্যাপারে স্ত্রীর উপর কোন প্রকারের চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। সাধারণভাবে দেনমোহর কম ধার্য করাই মুস্তাহাব।
রাসূল (সাঃ) বলেন –
“সে নারী বরকতের মাঝে আছে যাকে প্রস্তাব দেয়া সহজ ও যার দেনমোহর অল্প”
[মুসনাদু আহমাদ; হাসান সানাদে]
এ ছাড়া কুরআনের আরো এক আয়াতে দেনমোহরের অধিকার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
‘হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদেরকে, যাদের দেনমোহর তুমি প্রদান করেছো।’
[সুরা আল-আহজাব, আয়াত-৫০]
দেনমোহরের বিষয়টি হালকাভাবে নিয়ে লোক দেখানো ‘অধিক দেনমোহর’ ধার্য করাতে কোনো বরকত নেই। বরং তা অহংকারের পরিচায়ক।
বরকতপূর্ণ বিবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে উম্মাহাতুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতি বিয়ে, অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না।”
-মিশকাত শরিফ
দেনমোহরের পরিমাণ কী হওয়া উচিত ইসলামী শারীআতে এ সম্পর্কে বিশেষভাবে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি, কোন সুস্পষ্ট পরিমাণ ঠিক করে দেয়া হয়নি। তবে এ কথা স্পষ্ট যে, প্রত্যেক স্বামীরই কর্তব্য হচ্ছে তার আর্থিক সামর্থ্য ও স্ত্রীর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে উভয় পক্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বেঁধে দেয়া। আর মেয়ে পক্ষেরও তাতে সহজেই রাজী হয়ে যাওয়া উচিত।
দেনমোহর যে কতটা গুরুতপূর্ণ বিষয়, তা বুখারীর হাদীসই প্রমাণ বহন করে।
সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) বলেন, ‘’আমি অন্যান্য লোকের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উপবিষ্ট ছিলাম’’। তখন এক মহিলা দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমি নিজেকে আপনার জন্য হেবা করলাম, আপনি আমাকে গ্রহণ করুন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) কিছুই বললেন না।
মহিলাটি এরূপ তিনবার বলল, কিন্তু তিনবারই রাসূল (সাঃ) চুপ থাকলেন। তখন এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন আপনি যদি গ্রহন না করেন তাহলে এই মহিলার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিন। রাসূল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নিকট কি মহিলাকে দেনমোহর দেওয়ার মত কিছু আছে? তিনি বললেন, না। তখন রাসূল (সা.) বললেন তোমার বাড়ি থেকে খোঁজ করে একটি লোহার আংটি হলেও নিয়ে আসো। কিন্তু তিনি তাও আনতে পারেনি। তখন রাসূল (সা.) বললেন তোমার কি কোরআনের কিছু মুখস্ত আছে? তখন তিনি বললেন আমার ঐ ঐ সূরা মুখস্থ আছে। রাসূল (সা.) বললেন, মহিলাকে ঐ সূরাগুলো শিখিয়ে দিও, সেটাই তোমার দেনমোহর।
উপরোক্ত হাদীসটি দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে মহিলাকে দেনমোহর প্রদান করা অত্যাবশ্যক।
দেনমোহর একজন নারীর হক, যদি কোনো ব্যক্তি দেনমোহর অনাদায়ের ইচ্ছা নিয়ে বিয়ে করে তাহলে সে ব্যাভিচারী হবে। সে বিষয়েই রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যা মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে দেনমোহর দেওয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে, কিন্তু দেনমোহর দেওয়ার ইচ্ছে নেই, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ব্যাভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।”- মুসনাদে আহমাদ
সূরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াত, “এবং নারীদের মধ্যে সধবা নারী ছাড়া সকল নারীকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য, অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য নয়। সুতরাং তাদের মধ্যে তোমরা যাদেরকে ভোগ করেছ তাদেরকে তাদের নির্ধারিত মোহর দিয়ে দাও। আর নির্ধারণের পর যে ব্যাপারে তোমরা পরস্পর সম্মত হবে তাতে তোমাদের উপর কোন অপরাধ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।” এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, দেনমোহর হতে হবে বিক্রয়যোগ্য বস্তু সম্পদ।
দেনমোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। ন্যূনতম পরিমান হানাফি মাজহাবের মতে ১০ দিরহাম। অর্থাৎ ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য নির্ধারণ করা। এর চেয়ে কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা স্ত্রী রাজি হলেও তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না।
এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ১০ দিরহামের কম কোনো মোহর নেই (বায়হাকি শরীফ, ৭/২৪০)।
কিন্তু এর উপরে যে কোনো পরিমাণকেই দেনমোহর নির্ধারণ করা যাবে। তবে স্বামী যেহেতু দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য- তাই তার পরিশোধের সামর্থ্য বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করা উচিৎ। এমন কোনো সিদ্ধান্ত তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া আদৌ উচিৎ হবে না- যাতে সে তা পরিশোধ না করতে পেরে গুনাহগার হয়।
দেনমোহরের জন্য আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত পরিমান হল মোহরে ফাতেমি।
মোহরে ফাতেমি বলা হয় ঐ পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা, যা রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর মেয়ে হযরত ফাতেমা রাঃ-এর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। হযরত ফাতেমা রাঃ-এর মোহর ৫০০ দিরহাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, ১৫৩০.৯ গ্রাম রুপা (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া, ৪/৩৫০)।
হযরত উমর (রা.) এর খেলাফতকালে যখন মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে- তখন সাহাবারা (রাঃ) তাদের সন্তানদের বিয়েতে দেনমোহরে ফাতেমির চেয়ে অনেক গুণ বেশি দেনমোহর নির্ধারণ করতে শুরু করেন। হযরত উমর (রা.) দেনমোহরের ক্রমবৃদ্ধির গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি এত বেশি পরিমান দেনমহরের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু সূরা নিসার ৪ নম্বর আয়াত এর কারনে তা পারেননি।
সুরা নিসার ৪ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানিয়েছেন,
“তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে” [সূরা নিসা-৪]
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় দেনমোহর অনেক বেশিও হতে পারে।
তাই, কোনো প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়া ঢালাওভাবে সবার জন্য দেনমোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে- যা ইসলাম আদৌ পছন্দ করে না।
আবার মোহরে ফাতেমির চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ দেনমোহর পরিশোধের সামর্থ্য যদি স্বামীর থাকে তবে সেক্ষেত্রে দেনমোহরে ফাতেমিকে দেনমোহর নির্ধারণ করার দ্বারা স্ত্রীকে ঠকানো হয় ও নারীত্বের অবমাননা করা হয়। তাই দেনমোহরে ফাতেমিকে নয়, বরং স্বামীর সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ পরিমাণকে দেনমোহর করা উচিৎ।
অন্যসব অধিকারের মতো স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবি করা স্ত্রীর জন্য দোষের কিছু নয়। অনেকেই মনে করেন, দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে দিতে হয় শুধুমাত্র বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটলে। এটা অজ্ঞতা ও চরম ভুল ধারণা। বিয়ে বিচ্ছেদ না হলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা ফরজ।
অতএব এর যাবতীয় দিক শরীয়ত অনুযায়ী ও পরিষ্কারভাবে হওয়া উচিত এবং সে হিসেবেই তা পরিশোধের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
আমরা এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম যে দেনমোহর স্ত্রীর হক যা অবশ্যই স্বামীকে প্রদান করতে হবে এবং খুশি মনে প্রদান করতে হবে। এটা স্ত্রীর প্রতি কোন দয়া বা দান নয় বরং স্ত্রীর পাওনা।
আল্লাহু আ’লাম আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন ও আমাদের জন্য বিয়েকে সহজ করে দিন ।
কালেক্টড – মুরতাজা হাসান তাসকিন