দুআ কবুলের পথে যতো দেয়াল

দুআ কবুলের পথে যতো দেয়াল

প্রচন্ড হতাশায় মন ছেয়ে আছে, কিছুতেই আপনার সমস্যার সমাধান বের করতে পারছেন না, আপনার অনেক অনেক পরিকল্পনা কিন্তু এগোতে পারছেন না – এরকম মুহূর্তে আপনি কি করবেন?
আপনি আপনার প্রচন্ড হতাশাগ্রস্থ হৃদয় নিয়ে দুহাত তুলে হাজির হয়ে যাবেন আপনার রবের সন্নিকটে আর একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে অবলম্বন করবেন মুমিনের সবচাইতে বড় হাতিয়ার দুআর। আপনার সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর কাছে আপনার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরবেন এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দুআ করবেন।

আপনি জানেন আপনার এই দুআর ফল তিন রকমের হতে পারে যে ব্যাপারে নবীজী ﷺ বলেছেন,
“যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি দোয়া করে—যে দোয়ায় কোনো পাপ থাকে না, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় থাকে না, তাহলে আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতিতে তার দোয়া কবুল করেন। পদ্ধতি তিনটি হলো—
০১. সে যে দোয়া করেছে, হুবহু তা কবুল করা হয়।
০২. তার দোয়ার প্রতিদান পরকালের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
০৩. এই দোয়ার মাধ্যমে তার ওপর আসা কোনো বিপদ দূর করে দেওয়া হয়।”
[মুসনাদে আহমাদ]

অর্থাৎ আপনি জানেন আপনি ইহকাল নয়তো পরকালে দুআর ফলাফল পাবেন‌ই আর তাই দুআ চালিয়ে যান। কিন্তু মাঝেমধ্যে এরকম‌ও হয় আপনি দুআ করেই যাচ্ছেন কিন্তু আপনার অবস্থার কোনোরূপ পরিবর্তন হচ্ছে না, আপনার উপর থেকে বিপদ কাটছে না কিংবা আপনার ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না,উল্টো এমন‌ও দেখা যায় কখনো কখনো জীবনের প্রতিকূলতা বেড়ে যায়।
এরূপ অবস্থায় প্রথমত সবরের কোনো বিকল্প নেই কেননা আপনি আমি আল্লাহর নবী আইয়্যুব আঃ,যাকারিয়্যা আঃ এর ঘটনা জেনেছি। এমনকি আল্লাহ পাক আমাদের দুআ কবুলের ব্যাপারে অবগত করেছেন এই বলে,

“তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব। “
[সূরা আল মূমিন:৬০]

দ্বিতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব হচ্ছে নিজেকে বাজিয়ে দেখা যে, নিজের এমন কোনো গুণাহ আছে কিনা যা আপনার আমার দুআ ও আল্লাহর মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এমন কোনো ত্রুটি আছে কিনা যা আপনার আমার দুআকে আল্লাহর দরবারে পৌঁছতে বাধা দিচ্ছে।যদি ভালোমতো খেয়াল করি তবে কিছু দেয়াল আছে যা দুআকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে দেয় না-

দেয়াল নং ০১: হারাম উপার্জন

আল্লাহ পাক আমাদের আদেশ দিয়েছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর।
[সূরা আল বাকারাহ:১৭২]

অর্থাৎ ঈমানদার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পবিত্র খাদ্য ভক্ষণ করা আর পবিত্র খাদ্যের উৎস হালাল ও ন্যায়সম্মত উপায়ে অর্জিত রিজিক যাতে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য হ‌ওয়ার অবকাশ নেই এবং পবিত্র ও হালাল খাদ্য দেহ ও মনকে পবিত্র রাখতে সহায়ক।
আর এজন্যই এই আয়াতের পর নবীজী ﷺ বর্ণনা করেন এমন এক ব্যক্তির কথা যে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করেছে,যে সফরের ক্লান্তিতে ধুলি ধূসরিত রুক্ষ কেশধারী হয়ে পড়েছে এবং এই অবস্থায় আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতে হাত তুলেছে কিন্তু তার বাহ্যিক অবস্থাকে তার হারাম উপার্জন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আর নবীজী ﷺ সেই প্রশ্ন তুলেছেন,
“অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং আহার্যও হারাম। কাজেই এমন ব্যক্তির দু’আ তিনি কী করে কবুল করতে পারেন?”
[সহীহ মুসলিম,২২১৫]

দেয়াল নং ০২: তাড়াহুড়ো করা

আমাদের যে কত্ত তাড়াহুড়ো তা প্রতি ওয়াক্তের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হ‌ওয়ার প্রতিযোগিতা দেখলেই আঁচ করা যায়। আমরা যেন খুব কষ্টে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জন্য সময় বের করি অথচ গুরুত্বের দিক দিয়ে এই ফরজ ইবাদত আমাদের যেকোনো কাজের থেকে অগ্রগামী।এক‌ইভাবে আমরা আমাদের দুআর ব্যাপরে বেশ দ্রুততা অবলম্বন করি,যেখানে সময় নিয়ে আকুলতা ব্যাকুলতা নিয়ে নিজের অভাবের কথা আল্লাহর কাছে জানানোর কথা সেখানে আমাদের দুআকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলি।
অথচ নবীজী ﷺ বলেছেন,
“বান্দার দুআ সর্বদা কবুল করা হয় যদি সে দুআতে পাপ অথবা আত্মীয়তার সম্পর্কের ছিন্ন করার কথা না বলে এবং তাড়াহুড়ো না করে।” জিজ্ঞেস করা হল,”হে আল্লাহর রাসূল! তাড়াহুড়ো বলতে কি বুঝায়?”

তিনি সা বললেন, “দুআতে তাড়াহুড়া হল, প্রার্থনাকারী বলে আমিতো দুআ করলাম কিন্তু কবুল হতে দেখলাম না। ফলে সে নিরাশ হয় ও ক্লান্ত হয়ে দুআ করা ছেড়ে দেয়।”[জামে তিরমিজী, ৩৬০৪]
অর্থাৎ, আপনার আমার দুআর ব্যাপরে তাড়াহুড়ো করার নীতি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের দুআ কবুলের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় আর পরোক্ষভাবে আমাদের হতাশায় আচ্ছন্ন করে।

দেয়াল নং ০৩: উদাসীনতা

দুআ করার ব্যাপারে আমাদের আরেকটা বিশেষ ত্রুটি হচ্ছে উদাসীনতা, আন্তরিকতার অভাব।আমরা অধিকাংশ সময় সালাতের পর দুআ করতে হয় ভেবে দুআ করি,কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেশ কিছু দুআ মুখস্থ পাঠ করি এবং আমীন বলে উঠে যাই, কতোখানি উদাসীনতা অন্তরকে গ্রাস করে রাখলে আমরা এভাবে চলতে পারি কল্পনা করতে পারেন।
ধরুন আপনার বসের থেকে কিছু একটা আদায় করে নিতে চান,সেখানে অবশ্য‌ই আপনি যথেষ্ট নরম ও আন্তরিক আচরণ করবেন, আপনার প্রয়োজন যথেষ্ট একাগ্রতার সাথে তুলে ধরবেন এবং আশা প্রকাশ করবেন যে আপনার প্রয়োজন পূরণ হবে।

আর সেখানে আপনি তো সেই রবের নিকট আবেদন পেশ করছেন যার হাতে সবকিছু, আপনার বস আপনার ইচ্ছা পূরণ করার ক্ষমতা না রাখলেও আপনার রব রাখেন আর তাই সেক্ষেত্রে আপনার অন্তরে প্রত্যাশার পারদ যেমন সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা দরকার তেমনি একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সমন্বয়‌ও জরুরি।
এমনকি নবীজী ﷺ বলেছেন,
“তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ্‌ কোন উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।”
[জামে তিরমিযি, হাদীস নং ৩৪৭৯]

দেয়াল নং ০৪: পাপকর্ম

দুআর পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক পাপ কাজ।একদম শুরুতে হাদীসের দুআ কবুলের উপায়গুলো বলতে গিয়ে নবীজী ﷺ শর্ত শুনিয়েছিলেন,”যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি দোয়া করে—যে দোয়ায় কোনো পাপ থাকে না, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় থাকে না, তাহলে আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতিতে তার দোয়া কবুল করেন।”
অর্থাৎ কোনো পাপ কাজের জন্য দুআ না করলে আর পাপে জড়িয়ে না থাকলে দুআ কবুলের পথ খুলে যায়।এমনকি নবীজী ﷺ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো পাপের কথা উল্লেখ করেছেন।

দেয়াল নং ০৫: সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ দানে অনীহা

আল্লাহ পাক আমাদের উদ্দেশ্য করে বলেন,

“তোমরাই শ্রেষ্ঠ দল, মানবজাতির জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের জন্য নির্দেশ দাও, অসৎ কাজ নিষেধ করো ও আল্লাহয় বিশ্বাস করো।”
[সূরা আলে ইমরান:১১০]

অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ আমাদের উপর ফরজ বিধান,এই কাজ আমাদের পালন করতেই হবে অথচ এই দায়িত্ব থেকে আমরা ক্রোশ দূরে সরে গিয়েছি এবং এজন্য আমাদের দুআ কবুল হচ্ছে না কেননা নবীজী ﷺ বলেন,
“তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের প্রতি শাস্তি নাযিল করবেন অতঃপর তোমরা দুআ করবে কিন্তু তিনি তা কবুল করবেন না।”[জামে তিরমিযি, হাদীস নং ২১৬৯]

দেয়াল নং ০৬: ব্যাক্তিত্বের দুর্বলতা

এই দেয়াল কিছু বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্য নির্দিষ্ট যাদের ব্যাপারে নবীজী ﷺ বলেছেন,
“তিন ব্যক্তি এমন যে তাদের দুআ কবুল করা হয় না-

এক. যে ব্যক্তির অধীনে দুশ্চরিত্রা নারী আছে কিন্তু সে তাকে তালাক দেয় না।
দুই. যে ব্যক্তি অন্য লোকের কাছে তার পাওনা আছে কিন্তু সে তার স্বাক্ষী রাখেনি।
তিন. যে ব্যক্তি নির্বোধ ব্যক্তিকে সম্পদ দিয়ে দেয় অথচ আল্লাহ বলেন, তোমরা নির্বোধদেরকে তোমাদের সম্পদ দিও না।”
[হাকেম ও তাহাবী, হাদীস সহীহ, সহীহুল জামিঃ ৩০৭৫]

আসুন দুআ যেহেতু করছিই, সাহায্য ও অনুগ্রহের জন্য যেহেতু আল্লাহর স্মরণাপন্ন হচ্ছিই তবে দেয়ালগুলো ভেঙে ফেলে নিজেদের দুআ গুলো আল্লাহর কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাই, এমনভাবে প্রচেষ্টা চালাই যাতে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান পাই।

লিখেছেন

জেনারেল লাইনে পড়াশোনার ব্যস্ততায় দ্বীনি জ্ঞানার্জনের সুযোগ খুবই কম পেয়েছি তারপরও অনলাইন ভিত্তিক দাওয়াহ এবং ইসলামী ব‌ইয়ের সুবাদে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের সুযোগ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।
সেই জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ইসলামের সৌন্দর্যকে উম্মাহর সামনে ফুটিয়ে তোলার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমার এই টুকটাক লেখালেখি।

Exit mobile version