তারাবীহর রাকআত মানেই কিন্তু ৮ বনাম ২০ না। তারাবীহ তার চেয়েও বিশেষ কিছু। রামাদ্বান মাসে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাজের ধরণ সম্পর্কে আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) –কে জিজ্ঞেস করা হয়। আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) জবাব দেন:
“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাদ্বান মাসে ও অন্যান্য সময়ে (রাতের বেলা) ১১ রাকআতের বেশি নামাজ আদায় করতেন না। তিনি চার রাকআত করে মোট আট রাকআত আদায় করতেন। (তবে) এর সৌন্দর্য এবং দৈর্ঘ্য সম্পর্কে তুমি আমাকে আর প্রশ্ন করো না!”
[জামে আত-তিরমিজি: ৪৩৯]
আরেকটা বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ১৩ রাকআত নামাজ আদায় করতেন। যার মধ্যে বিতর এবং ফজরের দুই রাকআত সুন্নাতও আছে।
[সহীহ বুখারী: ১১৪০]
এই হাদীসগুলো কি আমি এজন্য উল্লেখ করলাম, তারাবীহর রাকআত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করার জন্য? না, আমি এজন্য উল্লেখ করিনি।
অনেক মসজিদে দেখবেন তারাবীহর নামাজ ৮ রাকআত পড়া হয়। যদি জিজ্ঞেস করেন, “৮ রাকআতই কেনো?
” আপনাকে বলা হবে, “এটা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাত।”
আমার প্রশ্ন হলো, শুধুমাত্র ৮ রাকাআত পড়াটাই কি সত্যিকার ‘সুন্নাত’?
এটা কি শুধুমাত্র সংখ্যাতেই (Quantity) সীমাবদ্ধ নাকি গুণের (Quality) সাথে সম্পৃক্ত?
রাতের নামাজ পড়ার সুন্নাত কেবলমাত্র সংখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যে হাদীসে আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সংখ্যার কথা বলছেন, একই হাদীসে তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তারাবীহ পড়ার গুণের কথা বলছেন- ‘এর সৌন্দর্য এবং দৈর্ঘ্য সম্পর্কে তুমি আমাকে আর প্রশ্ন করো না!’
আমরা তারাবীহর নামাজের রাকআত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করি, কিন্তু গুণের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যাই! আমরা ৮ রাকআত পড়ি বা ২০ রাকআত, আমাদের লক্ষ্য থাকে কতো তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করে বাড়ি যেতে পারি। যে মসজিদে দ্রুত তারাবীহর নামাজ পড়া হয়, আমরা সেই মসজিদে ছুটে যাই নামাজ পড়ার জন্য।
কিন্তু, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি এভাবে নামাজ পড়তেন?
একবার হুযাইফা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে রাতের নামাজে শরীক হোন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা বাকারা, কুরআনের দীর্ঘতম সূরাটির তেলাওয়াত শুরু করলেন। হুযাইফা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ভেবেছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়তো ১০০ আয়াত তেলাওয়াত করবেন। কিন্তু, না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তেলাওয়াত করেই গেলেন। হুযাইফা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ভাবলেন, পুরো সূরা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়তো দুই রাকআত নামাজ পড়বেন। দেখা গেলো, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরো সূরাটিই তেলাওয়াত করলেন, রুকুতে গেলেন না।
তিনি এবার সূরা আন-নিসা তেলাওয়াত শুরু করলেন, অতঃপর সূরা আলে-ইমরান তেলাওয়াত করলেন। একই রাকআতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের বড়ো-বড়ো তিনটি সূরা তেলাওয়াত করলেন। এতোটুকুতেই শেষ না! তিনি থেমে থেমে ধীরে ধীরে পড়ছিলেন, তাসবীহর আয়াত আসলে তাসবীহ পড়ছিলেন, দু’আর আয়াত আসলে দু’আ করছিলেন। রুকুতে গিয়ে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম’ পড়ছিলেন, সেটাও কিয়ামের মতো দীর্ঘ হচ্ছিলো।
‘সামিয়াল্লা হুলিমান হামিদাহ’ বলে যখন রুকু থেকে দাঁড়ালেন, তাঁর দাঁড়ানো রুকুর মতো দীর্ঘ হচ্ছিলো। সিজদায় গিয়ে যখন ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ পড়ছিলেন, সেটাও কিয়ামের মতো দীর্ঘ হচ্ছিলো।
[সহীহ মুসলিম: ১৬৯৯]
এই ছিলো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুধুমাত্র এক রাকআত রাতের নামাজের বিবরণ। এই এক রাকআত পড়তে কতো ঘন্টা লাগতে পারে? আমরা যে গতিতে নামাজ পড়ি, সেই গতিতে তো আমরা ৩৯ রাকআত নামাজ পড়ে বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিতে যতোক্ষণ সময় লাগে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক রাকআত নামাজ পড়তে তারচেয়েও বেশি সময় লেগেছিলো!
সাহাবীরাও লম্বা সময় নিয়ে তারাবীহর নামাজ পড়তেন। উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) খিলাফতের সময় তিনি দুজন সাহাবীকে তারাবীহর ইমাম হিশেবে নিয়োগ করেন। একজন হলেন তামিম ইবনু আউস আদ-দারী (রাদিয়াল্লাহু আনহু), আরেকজন উবাই ইবনে কা’ব (রাদিয়ালাহু আনহু)। তারা ১১ রাকআত করে নামাজ পড়াতেন। কিন্তু, নামাজের দৈর্ঘ্য এতো বেশি থাকতো যে, অনেকেই তাঁদের সাথে পেরে উঠতেন না। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হতো। তারপর রাকআতের সংখ্যা বাড়িয়ে ২০ করা হয়। তারপরও অনেকেই এতোক্ষণ দাঁড়াতে পারতো না। একসময় নামাজের রাকআতের সংখ্যা বাড়ানো হয়, যা ৩৯ রাকআতে গিয়ে থামে।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আযাদকৃত দাস না’ফে (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
“মদীনার মানুষকে আমি ৩৯ রাকআত তারাবীহর নামাজ পড়তে দেখেছি, যারমধ্যে ৩ রাকআত বিতর নামাজ অন্তর্ভুক্ত।”
অনেকেই অবাক হতে পারেন, এই ৩৯ রাকআত কোথা থেকে আসলো? এটা সাহাবী/তাবেঈদের সময় থেকেই চলে আসছে। মদীনার গভর্নর ইমাম মালিককে (রাহিমাহুল্লাহ) তারাবীহর নামাজের রাকআত সংখ্যা কমানোর জন্য বললে ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) প্রতিউত্তরে বলেন:
“আমি মানুষজনকে এটার উপর আমল করতে দেখেছি এবং এটি পূর্ববর্তীদের আমল।”
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ), যিনি জন্মগ্রহণ করেন ৯৩ হিজরিতে, তিনি বলছেন ‘পূর্ববর্তীদের আমল’ যিনি নিজেও ছিলেন একজন পূর্ববর্তী। তাহলে তাঁর পূর্ববর্তী কারা? সাহাবী, তাবে’ঈ।
এই কথাগুলোর মাধ্যমে আমি একটি কথাই বুঝানোর চেষ্টা করছি, আমরা যেখানে ব্যস্ত আছি তারাবীহর রাকআত সংখ্যার বিতর্ক নিয়ে, সেখানে আমাদের ব্যস্ত থাকা উচিত ছিলো তারাবীহর নামাজের গুণগত মানের ব্যাপারে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সাহাবী, তাবেঈ’র নামাজ কেবলমাত্র সংখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, তাঁদের নামাজের প্রাণ ছিলো নামাজের গুণগত মান।
আপনার মসজিদের ইমাম যদি সময় নিয়ে তারাবীহর নামাজ পড়ান, তাঁর ব্যাপারে অভিযোগ করবেন না। ইমাম সাহেব তো সেটার উপর আমল করে যাচ্ছেন, যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সাহাবী, তাবে’ঈ করেছেন।
পরিবর্তনের রামাদ্বান (পঞ্চম পর্ব)
আরিফুল ইসলাম