গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বন্ধুর ভূমিকা
বিয়ের দিন তারিখ পাকা হয়ে গেছে আবুল ইসহাকের। পরিবারের সবাই বিয়ের আয়োজনের প্রস্তুতি হিসেবে অন্যান্য বাজারের সঙ্গে গায়ে হলুদের বাজারের প্রস্তুতিতেও পিছিয়ে নেই। পরিবারের বড়ো এবং একমাত্র ছেলে বলে কথা। তাই একটু জাঁকজমক করে গায়ে হলুদ না করলে কী আর হয়! যাইহোক , বিয়ের বাজারে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ইসহাক তার বন্ধুকে ফোন করে বলল,
–হ্যালো সায়েম, তুই কোথায় আছিস?
–এই তো আমি তোদের বাসার কাছাকাছি-ই আছি। একটি কাজ সেরে তোদের এদিকেই যাচ্ছিলাম।
–ওহ! তাহলে তো ভালোই হলো। বন্ধু, তুই আমার বাসায় এখুনি চলে আয়। বিকেলের দিকে আমার বিয়ের বাজারের জন্য একটু বাইরে বের হবো। তোকে তো আগেই বলে রেখেছিলাম যে, তুই আমার বিয়ের সব কিছুতেই থাকতে হবে। তুই কথাও দিয়েছিলে।
–ঠিক আছে, বন্ধু! আমি তাহলে এক্ষুনি আসছি!
অতঃপর কিছুক্ষণ পর সায়েমের আসা হলো। এসেই মজা করে স্মিত হেসে বলল, কী মিয়া! বিয়ের জন্য খুব ফূর্তিতে আছিস, তাই না?
মুচকি হেসে ইসহাক জবাব দিলো, তা তো বটেই।
–এখন সকাল সকাল আবার কী করতে হবে? ফোন করে এখুনি আসতে বললে যে?
–আরে বন্ধু! গায়ে হলুদের বাজারের জন্য কী কী লাগবে সেটার একটি তালিকা তৈরী করতে হবে না! তোকে নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করতে চাচ্ছি। তাছাড়া, তোকে তো ফোনে বলেছি-ই যে, আজ বিকেলেই গায়ে হলুদের বাজার সেরে ফেলতে চাই। সেজন্য তোকে একটু তাড়াহুড়ো করে আনালাম।
কপাল কিঞ্চিত ভাঁজ করে চেহারায় অবাক হওয়ার দৃশ্য জিইয়ে রেখে সায়েম বলল, বন্ধু, কী বলছিস এসব? তুই তো আমাকে বিয়ের বাজারের কথা বলে নিয়ে এসেছিস। কই, আমাকে তো তুই গায়ে হলুদের বাজারের কথা বলছ নি!
–আরে, ওই একই কথা! বিয়ের বাজার মানেই তো গায়ে হলুদের বাজার।
–ইসহাক, তুই কি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করবি? তুই না একদিন আমাকে বলেছিলে যে, এসব অনৈসলামিক কর্মকান্ড তোর বিয়েতে করবি না। তা হলে এখন কেনো করতে চাচ্ছিস? তাছাড়া, তুই তো জানিস-ই আমি এসব শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ একদম-ই পছন্দ করি না।
–হ্যাঁ, তা তো বলেছিলাম-ই! কিন্তু কী আর করা, বল। পরিবারের সবাই যখন চাচ্ছেন তখন তো আর ‘না’ বলতে পারি না। জীবনে বিয়ে তো একবার-ই করবো তাই ভাবলাম একটু না হয় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করেই ফেললাম। একটু আনন্দ ফূর্তি না করলে কী আর হয়, বল! সবসময় তো আর করছি না। তাছাড়া, কতো মানুষজন-ই তো এসব করছে।
–এই যে বললি, কতো মানুষজন এসব করছে! তাহলে কি কতো মানুষজন জাহান্নামের অধিবাসী হলে তুইও বুঝি জাহান্নামীদের অধিবাসীদের একজন হতে চাইবি?
–না, বন্ধু! তা হতে চাইবো কেনো?
–তাহলে এসব খোঁড়া যুক্তি কেমনে দেখাস! আচ্ছা! তোকে একটি কথা জিজ্ঞেস করি?
–হ্যাঁ কর।
–আচ্ছা বলতো, কোনো সন্তান যদি তার বিয়েতে তার বাবাকে অমান্য করে, অসন্তুষ্ট রেখে বিয়ে করে তবে সেই সন্তানকে তুই কিভাবে মূল্যায়ন করবি?
–কী বলছ, বন্ধু! যে তার বিয়েতে তার বাবাকে অমান্য করে, অসন্তুষ্ট রেখে বিয়ে করতে পারে সে তো আদতে কোনো মানুষ-ই হতে পারে না। এমন জঘন্য মানুষও আছে নাকি যে বাবাকে অখুশি রেখে বিয়ে করতে পারে! আমি তো আমার বাবাকে অখুশি রেখে বিয়ে করার কথা চিন্তাই করতে পারি না। আমার বাবা আমাকে কতো আদর-যত্ন করে বড়ো করেছেন, মানুষ করেছেন। সেগুলো কী আর ভুলা যায়, এতোটা অকৃতজ্ঞ হওয়া যায়?আর বিয়ে একটি পবিত্র জিনিস। এমন পবিত্র জিনিসের শুরুতে বাবাকে অখুশি রাখার মতো অপবিত্র কাজ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
–এই তো সুন্দর বুঝেছিস। দেখ বন্ধু, তুই সামান্য কোনো বাবাকে অখুশি রেখে বিয়ে করতে যাওয়া সন্তানের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিস, অমানুষ বলে আখ্যা দিচ্ছিস, অপবিত্র কাজ বলে গণ্য করছিস অথচ এই তুই নিজেই তোর আমার সৃষ্টিকর্তা যিনি তোকে আমাকে সৃষ্টি না করলে আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না সেই তুই কিভাবে আসমান যমীন তথা সব কিছুর মালিক মহান রাব্বুল আলামিনকে অসন্তুষ্টি রেখে বিয়ের কথা ভাবতে পারিস?কিভাবে বিয়ের মতো পবিত্র জিনিসে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট রাখার মতো চরম অপবিত্র কাজের কথা ভাবতে পর্যন্ত পারলি?মহান আল্লাহকে অসন্তুষ্ট রেখে বিয়ের মতো পবিত্র কাজের শুরু করতে তোর কি একটুও কষ্ট হবে না রে বন্ধু?
–কী বলছিস এসব! আমি আবার মহান আল্লাহ তা’য়ালাকে অসন্তুষ্ট রাখছি কোথায়?
–দেখ ইসহাক, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ। কারণ এই গায়ে হলুদের মতো অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ থাকে, খুব রং-তামাশা হয় যা পর্দার মতো ফরয বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন হয়। এছাড়া, গান-বাজনা ইত্যাদি আর কতো কি তো আছেই। ইসলামিক সংস্কৃতিতে এসবের কোনো অস্তিত্বই নেই। এসব বেহায়াপনা অনুষ্ঠান বিজাতীদের কাছে থেকে আমদানিকৃত এক অনুষ্ঠান যা মুসলিমদের পালনের ব্যাপারে কঠিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আর যেসব কর্মকান্ডে আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘিত হয় সেসব কর্মকান্ড করতে যাওয়ার মানে কি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট রাখা নয়?আল্লাহর অসন্তুষ্টির বিষয় জেনেও কি তোর মতো একজন মুসলিমের আল্লাহর নাফরমানী করে বিয়ের যাত্রা শুরু করতে পারার কথা, বল?
তুই কি চাস তোর বিয়েতে আল্লাহ অখুশি থাকুন? নিশ্চয়ই তা চাস না। যেখানে তুই একজন বাবাকে অসন্তুষ্ট রেখে তার ছেলের বিয়ে মানতে পারছিস না সেখানে তুই কিভাবে তোর আমার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিনকে অসন্তুষ্ট রেখে বিয়ে করতে পারবি?আল্লাহকে অসন্তুষ্ট রেখে বিয়ের পর কিভাবে সুখী দাম্পত্য জীবন আশা করবি যেখানে আল্লাহ নিজেই সুখ দেওয়ার মালিক?
তোর বাবা যেমন তোকে এটা সেটা এনে দিয়ে আদর যত্ন করেছেন তেমনি আল্লাহও তো তোকে জন্ম থেকেই এমনকি যখন মায়ের পেটে একদম অসহায় অবস্থায় ছিলে তখন থেকেই বিভিন্ন নিয়ামত ভোগ করতে দিয়ে তার অসীম দয়ার চাদরে ঢেকে রেখেছেন এবং প্রতিনিয়ত রেখেই চলছেন। আল্লাহর যদি এতো এতো দয়া না থাকতো তবে যখনই আমরা আল্লাহর কোনো নাফরমানী করি তখনই তিনি ধ্বংস করে দিতেন।
আর এই যে, তুই তোর বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা বললে সেটা অবশ্যই ভালো কথা। কিন্তু বাবার চেয়েও কি আল্লাহর প্রতি হাজার গুণ কৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয়?কারণ এই আল্লাহ তা’য়ালা-ই তো আমাদের সবাইকে প্রতিনিয়তই একদম ফ্রি-তে অসংখ্য অগণিত নিয়ামত দিয়ে যাচ্ছেন। এই অক্সিজেনের কথাই ধর। অন্য সকল নিয়ামতের মতো একদম ফ্রি-তে অক্সিজেন নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এটা যে আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কতো বড়ো নিয়ামত তা তুই কৃত্রিম অক্সিজেনের সাহায্যে শ্বাস নেওয়া কোনো রোগীর কাছে গেলেই হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাবি। তখন বুঝবি অক্সিজেনের কী কদর এবং আরও বুঝবি যে, এই অক্সিজেনের পিছনে কতো হাজার কোটি টাকার চেয়েও বেশি টাকা ব্যয় করা থেকে আমরা বেঁচে যাচ্ছি। এটা তো কেবল একটিমাত্র নিয়ামতের কথা বললাম। এ রকম আর কতো লক্ষ-কোটি নিয়ামত ভোগ করে যাচ্ছি তা আমাদের দ্বারা কোনদিন-ই গণনা করেও শেষ হবার নয়।
আল্লাহ তা’য়ালা একটি সূরায় একত্রিশবার বলেছেন,
হে মানুষ ও জ্বীন, তোমরা তোমাদের মালিকের কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে?
[সূরা আর-রহমান: ১৩]
এখন আমাদের জন্য আল্লাহর এতোকিছুর পর তুই কিভাবে গায়ে হলুদের নামে এমন একটি অনুষ্ঠান করতে পারবি যেখানে আল্লাহর অসন্তুষ্টি রয়েছে?নিজের রবকে বেজার রেখে কোনো কিছু করতে তোর অন্তর কি একটুও কাঁপবে না?
দুনিয়ার কোনো মানুষ যদি তোকে অনেক সাহায্য করে তবে কি তুই সে সাহায্যের বিপরীতে তার সাথে এমন কোনো আচরণ করতে পারবি যে আচরণে কৃতজ্ঞতাহীনের প্রকাশ পায়?
–না, বন্ধু! তা তো কল্পনাও করা যায় না।
–তাহলে যে আল্লাহ আমাদেরকে প্রতিনিয়ত এতোসব নিয়ামতের মধ্যে রেখে সাহায্য করে যাচ্ছেন সেই আল্লাহর সাথে আমরা যদি তার সে সাহায্যের বিপরীতে নাফরমানী করে যাই, আল্লাহর দেওয়া বিধিনিষেধ অমান্য করে যাই তবে কি আল্লাহর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেলো?সেটা কি কোনোভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নমুনা হতে পারে?তাতে কি অনেক বড়ো ধরণের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাবে না?দুনিয়ায় অনেক জটিল জিনিস-ই তো আমরা কম-বেশি বুঝি কিন্তু আমরা এ বিষয়টি কেনো বুঝতে চাই না?
–আসলে বন্ধু, এভাবে তো আমি কোনোদিন চিন্তা করি নি তাই ব্যাপারটি ঐভাবে উপলব্ধিও হয় নি। সত্যিই বন্ধু, তোর বাস্তব কথাগুলো আমার ঘুমন্ত হৃদয়কে যেন জাগিয়ে দিয়েছে। ভাবনার জগতকে আরো প্রশস্ত করে দিয়েছে। এভাবে ভাবতে পারা কারোর-ই আল্লাহর নাফরমানী হয় এমন কিছু করতে পারার কথা নয়। কিন্তু বন্ধু, আমার মা বাবা থেকে শুরু করে পরিবারের সবাই তো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করতে নাছোড়বান্দা। তাদেরকে আমি কিভাবে বুঝাবো?
–আল্লাহর অসন্তুষ্টির প্রশ্নে এমন বিষয়কে গুরুত্বহীনভাবে দেখার কোনোই সুযোগ নেই, সুযোগ নেই কোনো বিষয়কে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর। ফলে যেভাবেই হোক তাদেরকে বুঝিয়ে এসব থেকে বিরত রাখতেই হবে। একজন মুমিন কখনোই তা থেকে পিছপা হতে পারে না। তুই তাদেরকে বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বলবি। ইন শা আল্লাহ! তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি বুঝবেন।
–হুম বুঝতে পেরেছি। তবে বন্ধু, তুই এক কাজ কর না। একটু কষ্ট করে তুই-ই আমার মা-বাবাকে বুঝিয়ে বল। তুই খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারিস। আমি তাদেরকে ডেকে নিয়ে আসি। কেমন?
–ইন শা আল্লাহ! আমি-ই তাহলে বলবো। তবে আন্টিকে আনার দরকার নেই। কারণ আমি আন্টির জন্য গায়েরে মাহরাম। তাই উনাকে এখানে আসতে বলিস না। আন্টিকে তুই-ই বুঝিয়ে বলিস।
–ওকে বন্ধু, আমি তাহলে আমার আব্বুকে ডেকে নিয়ে আনি, কেমন?
–না, আঙ্কেলকে এভাবে ডেকে আনা ঠিক হবে না। কারণ আঙ্কেলের মতো মুরুব্বিকে এভাবে ডেকে আনলে আদবের খেলাপ হবে। প্রয়োজনে আমি-ই আঙ্কেলের কাছে যাবো। তুই শুধু আঙ্কেলকে গিয়ে বল যে, আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই। আর তাতে যদি তিনি আমাকে উনার নিকট নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তবেই আমি সেখানে যাবো।
–ঠিক আছে, বন্ধু। তাহলে আমি আব্বুকে গিয়ে বলছি।
অতঃপর ইসহাক তার বাবাকে গিয়ে বলার পর তিনিই তার রুমে আসলেন যেখানে সায়েম বসে তার সাথে এতোক্ষণ কথা বলছিলো।
ইসহাকের বাবাকে দেখামাত্রই কাচুমাচু ভঙ্গিতে সায়েম শুদ্ধ করে সালাম করে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে নিলো। তারপর কিছুক্ষণ কথা বলার পর সে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গ এনে বলল, আঙ্কেল! বেয়াদবি মাফ করবেন! আমি আপনাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। অনুমতি দিলে বলবো।
–হ্যাঁ, বাবা! তুমি বলতে পারো। কোনো অসুবিধা নেই।
–প্রথমত বলে রাখি যে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করা-এটা একান্তই আপনাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে আমার হস্তক্ষেপের কিছু নেই। আমি কেবল একজন মুসলিম হিসেবে নিজের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কিছু কথা বলবো। ইন শা আল্লাহ!
তো আঙ্কেল! আমাকে দয়া করে একটু বলুন তো, আপনারা কি চান আপনাদের সন্তানকে এমন কিছু করার সুযোগ দিন যার ফলে আল্লাহ আপনাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে যান এবং আপনাদের জান্নাত হারাম হয়ে যায়?
–না, বাবা! আমার রব অসন্তুষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো এবং জান্নাত হারাম হয়ে যাওয়ার মতো এমন ভয়ঙ্কর কিছু তো আমরা আমাদের সন্তানকে কোনোক্রমেই করতে দিতে পারি না।
–তাহলে শুনুন আঙ্কেল। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তিন ধরণের ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তা’য়ালা জান্নাত হারাম করেছেন।
১) যে মদ তৈরী করে।
২) যে মাতা-পিতার নাফরমানী করে এবং
৩) দাইয়্যূস।
[মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ৫৮৩৯]
উল্লেখ্য, ওই ব্যক্তিকে “দাইয়্যূস” বলে -যে তার স্ত্রীকে ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে অশ্লীল কাজ ও ব্যভিচারের সুযোগ করে দেয় এবং সকল শরীয়াহ বিরোধী কাজকে মেনে নেয়। এমনকি যদি এসব কাজে মৌন সম্মতিও থাকে তবুও দাইয়্যূসের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এখন আঙ্কেল, আপনাদের আদরের ছেলেকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করতে দেওয়ার মানে হচ্ছে অশ্লীলতার সুযোগ করে দেওয়া সর্বোপরি শরীয়াত বিরোধী কাজের সুযোগ করে দেওয়া যা আল্লাহর চরম অসন্তুষ্টির অন্তর্ভুক্ত। কেননা এসব অনুষ্ঠানে ছেলে মেয়েদের অবাধ বিচরণ থাকে যারা নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করাতে ব্যস্ত থাকে, বিভিন্ন তামাশায় মেতে উঠে। এখানে পর্দার কোনো বালাই থাকে না। ফলশ্রুুতিতে, চক্ষু হেফাজতে বাঁধার সৃষ্টি হয়। আর এভাবেই পর্দার মতো ফরয বিধানের মারাত্মক খেলাপ হতে থাকে। এ বিষয়ে সূরা আন নূরের ৩০ এবং ৩১ নং আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে।
এছাড়া গান-বাজনা, ভিডিও করা, নন মাহরাম দ্বারা মেহেদী দেওয়া ইত্যাদি আরও কতকি তো আছে-ই।
জেনে বুঝেও মুসলিম হিসেবে আমরা কোনোভাবেই এসব অনুষ্ঠান পালন করতে পারি না, আঙ্কেল। আর মা বাবা হিসেবে সন্তানদেরকে এসব করতে দেওয়া মানে দাইয়্যূস হয়ে থাকা যার পরিণাম জাহান্নাম যা আমরা ওই হাদীস থেকেই পরিষ্কারভাবে জানতে পেরেছি। ইসহাককে বুঝিয়ে বলার পর যখন সে নিজেই তা পালন করতে চাইছে না তখন শুধু শুধু আপনারা কেনো আপনাদের চোখের মণিকে এসব কাজ করতে দিয়ে নিজেরা দায়্যূসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। ফলে দয়া করে আপনি বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখবেন, আঙ্কেল।
অপরদিকে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।
[সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস নং : ৪০৩১]
যেহেতু গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান মুসলমানদের কোনো অনুষ্ঠান নয় বরং অন্যে ধর্মের একটি অনুষ্ঠান সেহেতু তা পালন করার মাধ্যমে বিজাতীর সাংস্কৃতি অবলম্বন করা হয়ে যায়।
প্রসঙ্গক্রমে, রাসূল (সাঃ) একবার মহররমের সময় মদিনায় আসার পর দেখলেন মূসা (আঃ) এর অনুসরণে ইহুদীরা একটি করে রোজা রাখে তখন তিনি মুসলিমদেরকে পরের বছর থেকে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। কেননা তিনি চাননি তাদের ধর্মের সাথে সাদৃশ্য রেখে আমরা কিছু পালন করি। অর্থাৎ বিজাতীয়দের সাথে সাদৃশ্যতা এড়াতেই আরেকটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এজন্য আমরাও বিজাতীর সাদৃশ্যতা এড়াতে গায়ে হলুদের মতো আরও যতো বিজতীয় অনুষ্ঠান রয়েছে তা পালন করতে পারি না।
অন্যথায়, রাসূল (সাঃ) এর ওই হাদীস অনুযায়ী তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবো। আর তা কি সাংঘাতিক ব্যাপার! চিন্তা করছেন, আঙ্কেল?মুসলিম হয়েও যদি কাউকে অন্য ধর্মের দলভুক্ত হয়ে যেতে হয় তবে তার চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে?
আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করাতে একদিকে যেমন আল্লাহর নাফরমানী করা হয় আবার অন্যদিকে প্রচুর অর্থেরও অপচয় করা হয়। এছাড়া অনেক খাবারেরও অপচয় হয়ে থাকে যা খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেছেন,
তোমরা খাও এবং পান করো তবে কোনো অবস্থাতেই অপচয় করো না, কেননা তিনি (আল্লাহ তা’য়ালা) কখনো অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।
[সূরা আল আ’রাফ, আয়াত নং : ৩১]
কাজেই আঙ্কেল, এসব অনুষ্ঠানে এতো এতো টাকা অপচয় করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান না করে আপনি বরং গরিব মিসকিনদের পিছনে টাকাগুলো খরচ করতে পারেন। যিনি অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না তাকে কিছু টাকা চিকিৎসা করানোর জন্য দিতে পারেন, যিনি তার মেয়েকে অর্থের অভাবে বিয়ে দিতে পারছেন না তাকেও যথাসম্ভব অর্থ দিয়ে বিয়ের জন্য সহযোগিতা করতে পারেন। মানুষদেরকে বিশেষ করে আপনার অসচ্ছল আত্নীয়স্বজনকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারেন। এতে আত্মীয়রা অনেক খুশি হবেন এবং সম্পর্কও অটুট থাকবে। আর এভাবে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবেন, অর্জন করতে পারবেন ভুরি ভুরি সওয়াব যা আখিরাতের পাথেয় হিসেবে কাজে দিবে।
বিশ্বাস করুন আঙ্কেল, কাউকে এরকম সাহায্য করতে পারলে আপনি দেখবেন আপনার হৃদয়ে অন্য রকম এক শান্তি অনুভব করছেন। মনের মধ্যে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করবে। আর এগুলোর বরকতে আপনার ছেলের দাম্পত্য জীবনও অনেক সুখের হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিকে কেন্দ্র করে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে তার বৈবাহিক জীবন শুরু করে তাকে আল্লাহ তা’য়ালা নিশ্চয় নিরাশ করবেন না, স্বামী-স্ত্রীর অমিল তথা পারিবারিক অশান্তিতে রাখবেন না। আর আখিরাতেও পুরষ্কৃত করা থেকে বঞ্চিত রাখবেন না। ইন শা আল্লাহ! আমাদেরকে সর্বদা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল রাখতে হবে।
–দারুণ তো, তুমি তো দেখছি অনেক কিছুই জানো। সত্যি বলতে লজ্জা নেই, তোমার কাছ থেকে আমি নতুন করে আজ অনেক কিছুই জানলাম, বাবা।
আর এগুলো জেনেও মুসলিম হিসেবে আমরা কোনোক্রমেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করতে পারি না। তোমার কাছ থেকে জানাতে ভালোই হলো। ফলে এসবের দিকে আমি আর এগুচ্ছি না। বাবা, তোমার নামটা যেনো কী বলেছিলে?
–আঙ্কেল, আমার নাম সায়েম আহমেদ।
–খুব সুন্দর নাম। তোমার নাম যেমন সুন্দর তেমনি তোমার কথাগুলোও সুন্দর। আমি চাই তোমার মতো বন্ধুর সাথে আমার ছেলের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক। তোমার মতো বন্ধুর সাথে থাকলে কারো অন্তত দ্বীন থেকে ছিটকে গিয়ে বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
–আঙ্কেল, আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেনো আল্লাহ আমাদেরকে তার প্রিয় বান্দা হিসেবে কবুল করে নেন।
–দোয়া তো অবশ্যই, বাবা! আমার জন্যেও দোয়া করো। তাহলে আমি এখন যাই, বাবা। তোমরা কথা বল। আর হ্যাঁ! বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে যেয়ো কিন্তু।
–জাযাকাল্লাহু খাইরান, আঙ্কেল। আসলে হয়েছি কি! আজ একটু আমার তাড়া আছে তাই একটু সকাল সকাল যেতে হবে। অন্য একদিন এসে খেয়ে যাবো। ইন শা আল্লাহ! আর আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত, আঙ্কেল!
–তাড়া যেহেতু আছে, কী আর করা! অন্যদিন এসো খেয়ো কিন্তু। আর আমাকে কষ্ট দিলে কোথায় তুমি! কষ্ট তো আমরাই তোমাকে দিচ্ছি। তোমার মতো বিনয়ী ছেলেমেয়েদের এই একটাই অভ্যাস যে, কষ্ট না দিয়েই বলে নাকি কষ্ট দিচ্ছে।
অবশেষে ইসহাকের বাবা প্রস্থান করার পর সে তার বন্ধুকে খুশিমনে বলল, সায়েম! তোকে অনেক ধন্যবাদ বন্ধু। তুই আমাকে এবং আমার বাবাকে অনেক সুন্দর করে বুঝিয়েছিস। তোর মতো দ্বীনি বন্ধুর সংস্পর্শে থাকা মানে নিজেকে দ্বীনের আলোয় আলোকিত করা। সত্যিই আজ তুই আমাকে এবং আমার পরিবারকে এমনকি আমার আত্মীয়দেরকে যারা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য মুখিয়ে আছেন তাদেরকেও অনেক বড়ো নাফরমানী ও কবিরা গোনাহ থেকে রক্ষা করেছিস।
–আলহামদুলিল্লাহ, বন্ধু! গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে তোদের সরে আসা দেখে সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে।
–আমারও ভালো লাগছে, বন্ধু!
–তো, ইসহাক! এখন আমি যাই। শীঘ্রই আবার দেখা হচ্ছে। ইন শা আল্লাহ! ও হ্যাঁ! আন্টিকেও কিন্তু বিনয়ের সহিত বিষয়টি বুঝিয়ে বলিস। কেমন?
–হ্যাঁ, অবশ্যই বলবো।
সায়েম বাসা ত্যাগ করার কিছুক্ষণ পর মা জহুরা খাতুন ছেলের রুমে আসলেন। এসেই জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, ইসহাক! তোমার গায়ে হলুদের জিনিসপত্রের তালিকা তৈরী করেছো?
–না, মা! তোমার সাথে একটু কথা আছে।
–কী কথা, বাবা?কোনো টাকা লাগবে?
–না, মা! এসব কিছু লাগবে না।
–তবে কী, বলো?
–মা, আমি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করবো না।
–কেনো রে বাবা? কী হয়েছে? কেনো করবি না?
সবাই তোর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন। তোর বড়ো খালাও একটু পর আমাদের বাসায় আসছেন। তোর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমাদের আরও কতো আত্নীয়স্বজন আসছেন। আর এখন তুই এসব কী আবোলতাবোল বলছিস?
–হ্যাঁ মা, আমি ঠিকই বলছি এবং বুঝেশুনেই বলছি।
তারপর ইসহাক তার মাকে কাছে বসিয়ে তার বন্ধু সায়েমের বলা কথাগুলো বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো এবং মা-ও মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলো শুনলেন। ছেলের কথাগুলো শুনে তিনি ভাবলেন, যেহেতু ছেলে নিজেই এসব অনুষ্ঠান করাতে রাজি নয় তাই শুধু শুধু কেনো আমরা এমন কিছু করবো যার জন্য নিজেদেরই জান্নাত হারাম হয়ে যায়, যার জন্য আল্লাহই অসন্তুষ্ট থেকে যান। তারপর ছেলেকে বললেন, ঠিক আছে, বাবা!
আমার কোনো অসুবিধে নেই। আমি রাজি আছি।
মায়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, I love you, মা! তুমি আমার বেহেশতের চাবি। আমার জন্য বেশি বেশি দোয়া করো, মা। মা-ও তার ছেলের মাথা বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, দোয়া তো অবশ্যই, বাবা। আল্লাহ তোমার দুনিয়া ও আখিরাতে মঙ্গল করুন।
আমিন!
এদিকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে না শুনে তার কাজিনদের একেকজন মুখ খুব ভারী করে বসে আছে যেনো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাওয়ার বিষয় তারা কোনোভাবেই মানতেই পারছে না। কিন্তু কী আর করা! আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রশ্নে তো আর এগুলোকে কোনোক্রমেই হালকাভাবে নেওয়া যায় না। অবশেষে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছাড়াই ইসহাক তার দ্বীনি বন্ধুর দ্বীনি পরামর্শে ইসলামিক নিয়মানুযায়ী পর্দা বজায় রেখে সুন্নতী তরীকায় বিয়ে সম্পন্ন করলো। এসব দেখে সায়েম আল্লাহর প্রশংসা করে বলল, আলহামদুলিল্লাহ!
কিছু কথাঃ
বিয়ের মাধ্যমে জীবনের নতুন আরেক যাত্রা শুরু হয়। আর এই নতুৃন যাত্রার শুরু এমনভাবে করা উচিত নয় যেভাবে করলে স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন অসন্তুষ্ট থাকেন।
আল্লাহ তা’য়ালার অবাধ্যতার মাধ্যেমে এই যাত্রা শুরু করে কিভাবে আমরা সুখ আশা করব! কাজেই আমরা যদি বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মিল মহব্বত চাই, পরকীয়ার মতো ভয়ানক ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকতে চাই সর্বোপরি সুখী হতে চাই তবে যেনো আমরা রাসূল (সাঃ) এর তরীকার বাইরে গিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিয়ে না করি। আমরা যারা এ বিষয়ে সচেতন আছি তাহলে তো অনেক ভালো।
আলহামদুলিল্লাহ! তবে আমরা যেন অন্যেদরেকেও এ বিষয়টি বুঝানোর জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি। অন্যেদেরকে বললে এসব শুনবে না-এমন ধারণা নিয়ে বিষয়টির প্রতি উদাসীনতা রাখা মোটেও সমীচীন নয়।
আমরাও সায়েমের মতো আমাদের বন্ধু- বান্ধবদেরকে বুঝিয়ে এসব করা থেকে বিরত রাখতে পারি। আচ্ছা! বিরত রাখতে না পারি অন্তত বুঝাতে তো পারি। কেবল প্রয়োজন তাদেরকে বুঝানোর মন মানসিকতা থাকা। যাইহোক, মানুষদেরকে সচেতন করার ব্যাপারে আমাদের চেষ্টার যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। আর বিশেষ করে আমাদের অধীনস্থ যারা রয়েছেন তাদেরকে কোনোক্রমেই এসব অশ্লীলতার বা শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজের সুযোগ দিয়ে এমনকি তাতে মৌন সম্মতি দিয়েও যেন আমরা দায়্যূসের ভূমিকায় নিজেদেরকে দাঁড় না করাই।