মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় বাচ্চারা শুনতে পায় কিনা
কখনো ভেবে দেখেছেন কি? মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় বাচ্চারা শুনতে পায় কিনা?
মাতা-পিতা হবার বাসনা বাঁধেনি এমন কোন বিবাহিত দম্পতি আপনি খুঁজেও পাবেন না কেননা, বিয়ের পর আল্লাহ তায়ালার এক অনন্য উপহার হলো সন্তান। যখন একজন মায়ের মাতৃত্বকে অলংকৃত করে কলিজার টুকরো সন্তান জন্ম নেয় তখন সব মা-বাবা ই সন্তানকে সুস্থ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নূন্যতম চেষ্টাও বাকি রাখে না। গর্ভাবস্থায় সবাই সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য চেষ্টার কমতি না রাখলেও সন্তানের বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি, জ্ঞান-গরিমা বৃদ্ধিতে কি কি করা দরকার, কিভাবে আগানো দরকার সে ব্যাপারে উৎসাহী কাউকেই দেখা যায় না বললেই চলে।
এর বিশেষ কারণ- গর্ভাবস্থায় সন্তান যে শুনতে পায়, কিছু বিশেষ কাজ সন্তানের ব্রেইন ড্রেভলপমেন্টে ভূমিকা রাখে সে ব্যাপারে আমাদের জানা শোনা নেই বললেই চলে।
কি ভাবছেন?
গর্ভাবস্থায় সন্তান শুনতে পায় নাকি আবার?
যদি শুনতেও বা পায়, অতটুকু একটা মানুষ ও কিইবা মনে রাখতে পারবে?
গর্ভাবস্থায় বাচ্চা শুনতে পায় কিনা, সে ব্যাপারে গবেষণা কি বলে তা দেখার আগে গর্ভাবস্থায় বাচ্চার শ্রবণশক্তি কিভাবে গঠিত হয় তা আগে জেনে নিই-
৫ম সপ্তাহে
কানের ভেতরের অংশ ডেভলপ করা শুরু করে।
১২ সপ্তাহে
ককলিয়া এবং মধ্য কর্ণ গঠন হতে থাকে।
18 সপ্তাহে
গর্ভের ছোট্ট মানুষটি তাদের প্রথম শব্দ শোনার সক্ষমতা লাভ করে।
২২ সপ্তাহে
দেহের অভ্যন্তরীণ মৃদু শব্দগুলি শুনতে পায় যা আপনি শুনতে পান না। এর মধ্যে রয়েছে আপনার হার্টবিট, আপনার ফুসফুসে শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ, আপনার পেটের বাওয়েল সাউন্ড এবং এমনকি আমবিলিগাল কর্ডের মধ্য দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের শব্দও শুনতে পারে।
২৩ সপ্তাহে
গর্ভের বাইরের শব্দ শোনা শুরু হয় বিশেষ করে লো পিচ শব্দগুলি শুনতে শুরু করে।
26 সপ্তাহে
গর্ভাশয়ে থাকা বাচ্চা কণ্ঠ এবং শব্দের প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হয়ে যায়। এ সময়ে গর্ভবতী মা শব্দের প্রতিক্রিয়ায় বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন। প্রিনেটাল আল্টাস্নোগ্রামে শব্দের সাথে বাচ্চার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন পরিবর্তন করতে দেখা যায়।
৩২-৩৫ সপ্তাহে
মধ্যকর্ণ, বহিঃকর্ণের গর্তসহ কানের বাইরের অংশ পূর্ণাঙ্গরুপে গঠন হয়ে যায়। তৃতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে, বাচ্চা মায়ের ভয়েস সনাক্ত করাও শিখে যায়।
গর্ভাবস্থায় বাইরের শব্দগুলো শরীরের এতোগুলো লেয়ার ভেদ করে অ্যামনিয়োটিক ফ্লুয়িডে থাকা বাচ্চার কানে স্পষ্টভাবে না পৌঁছুলেও বাচ্চা মায়ের শব্দ বেশ ভালোভাবেই শুনতে পায়।
নিজের মুখে হাত রেখে চেপে ধরে কথা বলার চেষ্টা করে দেখুন, আপনি যেমনটি শুনতে পেলেন মায়ের গর্ভে বাচ্চা বাইরের শব্দ অনেকটা সেরকমই শুনতে পায়।
২০১২ সালে Belfast University এর ফেটাল হেয়ারিং এক্সপার্টরা মায়েদের দুইটা গ্রুপের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেন, একটা গ্রুপ যারা গর্ভাবস্থায় বিট্রিশ টেলিভিশনে প্রচারিত একটি জনপ্রিয় শো প্রতিদিন দেখতেন এবং অপরগ্রুপ কখনোই দেখেনি। বাচ্চা জন্মের পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় ওই শো এর মিউজিক বাজানো হলে যে বাচ্চার মায়েরা গর্ভাবস্থায় শো দেখতো তাদের বাচ্চারা প্রতিক্রিয়া দেখায়, আর যারা কখনোই শো দেখেনি তাদের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
প্রিনেটাল স্টেজে খুব মনোযোগের সাথে বাচ্চার যত্ন নিতে হয় কারণ এই সময়ে ঘটে যাওয়া যেকোন নেগেটিভ পজেটিভ কাজ বাচ্চার পরবর্তী জীবন ইফেক্ট রাখতে পারে।
Qudus International Journal of Islamic Studies এর গবেষণা অনুযায়ী-
এটা ফারিহ আব্দুর রহমানের সত্যি ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত ৪ বছর বয়সের মধ্যে কুরআন এ হাফিজ হওয়া ফারিহ আব্দুর রহমান যখন মায়ের গর্ভে ছিলো, তার মা সবসময় সূরা আল কাহাফ তিলাওয়াত করত, শুনতো এবং তার বাচ্চার সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরী করার চেষ্টা করত। ফারিহ জন্মগ্রহণের পর দু বছর বয়সে যখন কথা বলতে শেখে তখন তার বলা প্রথম কথা ছিল সূরা আল কাহাফ আয়াত। তার মা-বাবার প্রচেষ্টায় অল্প বয়সে কুরআনে হাফিজ হয়ে যায়, এত দ্রুত যা সাধারণত পরিণত বয়সীদের দিয়েও সম্ভব হয় না।
ডা. আল কাদি (from USA in Al Battar- 2012) কুরআন পড়ার সময় অনূভুতিগত ফিজিওলজিক পরিবর্তন নিয়ে তার করা রিসার্চে দেখা যায়- আরবি বলতে পারা বা না পারা উভয়েরই কুরআন পাঠে ডিপ্রেশন, স্যাডনেস, মানসিক দুশ্চিন্তা, বিভিন্ন রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর করা সহ মানসিক প্রশান্তি এবং রোগ নিরাময়ে প্রায় ৯৭% মানুষের উপর বৃহত্বম প্রভাব ফেলে।
পরবর্তীতে এ গবেষণার ফলাফল মোহাম্মদ সালিম এর পরিচালিত একটি গবেষণা দ্বারা আরো জোরদার হয়, যা Boston University তে প্রকাশ করা হয়েছিল। যারা অদৌ আরবি বুঝতে পারেনা এবং পরীক্ষার পূর্বে তাদেরকে যে কুরআন শোনানো হবে তাও বলা হয়নি, এমন তিন জন নারী এবং দুই জন পুরুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়।
দুইটা সেশনে করা পরীক্ষাতে প্রথমবার তারতিল সহ কুরআন পাঠ করে শোনানো হয় এবং এরপর কুরআনের বাইরে আরবি ভাষা থেকে একইভাবে পাঠ করে শোনানো হয়। ২১০ বার পরিচালিত এই পরীক্ষায় দেখা যায়- অংশগ্রহণকারীদের ৬৫% কোরআন শোনার সময়ে প্রশান্তি অনুভব করেন অপরদিকে, অংশগ্রহণকারীদের মাত্র ৩৫% কুরআনের বাইরে আরবি ভাষা শোনার সময় শান্তি অনুভব করেন।
বাচ্চাদের উপরে কুরআন যে একটা দারুন প্রভাব তৈরি করে করে এ ব্যাপারে ১৯৯৫ সালে কাউন্সিলিং এন্ড সাইকোথেরাপি সেমিনারে মালায়ের ড. নূর হায়াতি একটি রিসার্চের বিবৃতিতে বলেন- তার করা রিসার্চ অনুযায়ী ৪৮ ঘন্টা বয়সের একটি বাচ্চাকে কুরআন শোনানো হলে দেখা যায় বাচ্চারা সাড়া দেয়, খুশি হয় এবং শান্ত হয়ে যায়।
ফিব্রিয়াতি নামক একজন মিডওয়াইফারির দীর্ঘমেয়াদি রিসার্চ এর ফলাফল এ উঠে আসে, সে গর্ভবতী অবস্থায় বার বার কুরআন শুনতো এবং তিলাওয়াত করতো।
পরবর্তীতে তার বাচ্চা যখন ৩-৫ বছরে উপনীত হয় তিনি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দেখতে পান-
১. তার বাচ্চাকে ধর্মীয় বিষয় দুআ, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতের দিকে মনোযোগী করা সহজ হয়ে গিয়েছিল।
২. তার বাচ্চা ইবাদতে উৎসাহ বোধ করতো।
৩. তার বাচ্চার সেনস অফ মোরালিটি, সচেতনতাবোধ, অনুসুচনাবোধ সহজেই গড়ে উঠেছিল।
৪. সে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয় এবং স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন হয়েছিল।
৫. তার সুন্দর কল্পনা শক্তি গড়ে উঠার পাশাপাশি,ভাল বক্তৃতা দেয়ার দক্ষতা এবং শুদ্ধ উচ্চারণ ও স্পষ্ট করে ফ্লুয়েন্সিসহ কুরআন পড়তে ও বলতে পারার দক্ষতা খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পেরেছিল।
বিভিন্ন গবেষণা ও মেডিকেল সায়েন্সের তথ্য অনুযায়ী সহজেই বোধগম্য- মা যদি শান্তি, আরাম অনুভব করেন তবে তার গর্ভের সন্তানেরও শান্তি ও আরামদায়ক অনুভূতি হয় অর্থাৎ মায়ের বাহ্যিক অবস্থা বাচ্চার উপর প্রতিফলিত হয়।
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার শ্রবণশক্তি ও বোধশক্তি ডেভেলপমেন্টের সময় জুড়ে কুরআন তিলাওয়াত, পড়া ও শোনা বাচ্চার উপর একটি সুন্দর প্রভাব তৈরি করে। যা পরবর্তী জীবনে সন্তানদের বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি অর্থাৎ শুধু IQ (Intelligence Quotient) , EQ (Emotional Quotient) ই বৃদ্ধি করে না, বরং SQ (Spiritual Quotient) ও বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
এবার সিদ্ধান্ত আপনার হাতে, প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান গর্ভাবস্থায় শয়তানের সুর মিউজিক শুনে দুনিয়ায় জন্ম নেবে, নাকি গর্ভাবস্থায়ই মহান আল্লাহর অলৌকিক কিতাব আল কুরআনের মাধুর্যতা শিখিয়ে দুনিয়ার আলো দেখাবেন।