খতমে বুখারি কওমি মাদরাসার সমাবর্তন
খতমে বুখারীর নানাদিক
আমাদের মাদরাসাগুলোতে বিগত বছরগুলোতে বুখারী শরীফ খতমের নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। ইদানিং এটা নিয়ে নতুন চিন্তাও শুরু হয়েছে। আমাদের আকাবির ও মুরুব্বীগণ এটাতে বিদআত হওয়ার ঝুঁকি লক্ষ করছেন। দারুল উলূম দেওবন্দের হযরতগণ, শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ সহ অনেকেই অদূর ভবিষ্যতে এটি বিদআতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অনেক বিজ্ঞ মুরুব্বী কিছু না বললেও এজাতীয় অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলছেন। তবে সরাসরি এটাকে কেউ বিদআত বলেছেন, আমার নজরে পড়েনি। শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানী হাফি. স্পষ্ট বলেছেন, ”আমি এটাকে বিদআত বলছি না, তবে বিদআতে রূপ নেয় কিনা, এটা নিয়ে ভয় করছি।”
বিদআত হওয়ার যে উপাদান ও মাদ্দা থাকতে হয়, এখনই সেটি পাওয়া যায়নি। যেমন অশরঈ বিষয়কে ইবাদত বা সওয়াব মনে করে করা- বিদআত হওয়ার সবচে বড় লক্ষণ। কোনো সাধারণ বিষয়কে শরীয়তের কাজের মতো জরুরী মনে করা ইত্যাদি।
বুখারীর খতম অনুষ্ঠানকে ব্যাপকভাবে যারা আয়োজন করেন, তাদের কেউ বিশেষ সওয়াব বা ইবাদত মনে করেন বলে মনে হয় না। স্রেফ ইলম শেখার একটি উন্মুক্ত ও ব্যাপক আয়োজনই তারা মনে করেন এটাকে। যেমনটি মাদরাসার বিশেষ কাইফিয়াতে সারাবছর ক্লাস করাকে কেউ সওয়াব বা ইবাদত মনে করেন না। তবে শেষ দরসে যেভাবে গণসম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায়, এবং জনগণকে এতে অংশগ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাতে সাধারণ মানুষ এটিকে বড় সওয়াবের কাজ মনে করে বসতে পারে। এটাই হলো শঙ্কার কথা।
ইলতিযাম তথা আবশ্যক মনে করাও বিদআত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। প্রতি বছর আয়োজন করা, এটাকে বাধ্যতামূলক মনে করা দ্বারাও জনমনে এটার ব্যাপারে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। ভাবতে পারে- এটা নিশ্চয় শরীয়তের কোনো জরুরী কাজ। এটাও বেদআত হওয়ার পথ। এসব আশঙ্কায় আমাদের আকাবির হযরতগণ এটার ইলতিযাম ছেড়ে দিচ্ছেন।
এ ঝুঁকিগুলোর কথা বাদ দিলে খতমে বুখারী বা এ জাতীয় দরসের নানা সৌন্দর্য্য ও উপকারীতা রয়েছে।
১. ছাত্রদের জন্য হাদীসের সনদ আ’লী করা। সুধীজন মাত্রই জানেন- হাদীস শাস্ত্রে আ’লী সনদ তথা উচ্চ সনদের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যুগের কোনো বিজ্ঞ মুহাদ্দিসের মাধ্যমে ছাত্রদের সনদকে আ’লী করার সুযোগ করে দেওয়া হয়, উস্তাদ ও মাদরাসাওয়ালাদের উদারতা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। মফস্বলে দাওরা খোলা অনেক মাদরাসায় হয়তো সে উচ্চ সনদ নেই। বেশিরভাগ উসতাযই তরুণ।
২. যুগের কোনো বড় আলিম ও মুহাদ্দিস থেকে ইলম হাসিলের সুযোগ করে দেওয়া। ছেলেরা বড় বড় মাদরাসায় এবং বড় বড় মুহাদ্দিসের কাছে পড়তে চায়। কিন্তু অসঙ্গতি ও অসামর্থ্যর কারণে সেটা তাদের হয়ে ওঠে না। অন্তত এক/দুটি দরসের মাধ্যমে ছেলেদেরকে সে সুযোগ করে দেওয়া কল্যাণকর বৈ কি? অবশ্যই সেটা শেষ দরস হওয়া জরুরী নয়। বরং সারা বছরই এমন দরসের আয়োজন করা যেতে পারে।
৩. দরসে গণসম্পৃক্ততা। ইলম একটি আ’ম জিনিষ। যেটা এতদিন কেবল মাদরাসায় ভরর্ হওয়া ছাত্ররাই হাসিল করেছে, দুয়েকটি গণদরসের মাধ্যমে সেটাতে জনগণকেও সম্পৃক্ত করা। এতে করে তারা খুশি হয়। সাথে সাথে মাদরাসা শিক্ষা ও হাদীসের দরসে একটি বিশেষ প্রদর্শনীও হয়ে যায়। জনগণ এতে করে তার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও কদর ও কীমত বুঝতে সক্ষম হয়। জাগতিক শিক্ষার তুলনায় এর বৈশিষ্ট্য পরখ করার সুযোগ পায়।
৪. গণপ্রার্থনার আয়োজন। মাদরসার সাথে সংশ্লিষষ্ট জনগণ, দাতা ও শুভাকাঙ্খীদেরজন্য দুআর আয়োজন করা হয়। এবং জনগণকে একজন ইলমী ব্যক্তিত্ব ও আল্লাহওয়ালার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। সারাবছরই তো এদের জন্য দুআ করা হয়। কিন্তু একটি অনুষ্ঠানে তাদেরকেও সম্পৃক্ত করতে পারলে জনগণের সাথে মাদরাসা ও উলামায়ে কেরামের সম্পকৃ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে এ সম্পর্ক বৃদ্ধির গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
৫. অনেক মাদরাসার আথির্ক বিষয়টি এর সাথে জড়িত, যদি সেটা বড় আকারে করা যায়। বছরের শেষ প্রায় মাদরাসার রিজার্ভ প্রায় শূন্য থাকে। এমন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাদরাসার বেশ কিছু অর্থ ফান্ডে আসতে পারে, যা বছরের শেষে শূন্য ফান্ডে অনেক বড় সংযোজন। এতে শিক্ষক ও ছাত্রেদের বহু উপকার হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বুখারী খতম অনুষ্ঠানকে মাদরাসার জরুরতও বলা যেতে পারে।
মোটকথা, এমন অনুষ্ঠানের নানা উপকারী দিক রয়েছে। যদি সেটা ওইসব নিয়তে করা হয়। ইন্নামাল আ’মালু বিন্নিয়াত। আলউমুরু বিমাকাসিদিহা।
তবে কয়েকটি বিষয় আপত্তির কারণ। এগুলো বাদ দিতে পারলে এজাতীয় অনুষ্ঠানে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
ক. ইলতিযাম তথা প্রতিবছর করাকে আবশ্যক না করা। একে রেওয়াজ বা প্রথায় পরিণত না করা। মাঝে মাঝে করা, মাঝে মাঝে ছাড়া।
খ. বছরের শেষে হওয়াকে জরুরী মনে না করা। সারাবছরে, বছরের শুরু মাঝে শেষে যেকোনো সময় হতে পারে।
গ. সহীহ বুখারীকে জরুরী মনে না করা। এটি ছাড়া যেকোনো কিতাবের গণদরস হতে পারে। বিশেষ করে কুরআনুল কারীম কেন্দ্রিক হওয়া বাঞ্চনীয়।
ঘ. খতম কেন্দ্রিক না হয়ে ইফতিতাহ বা শুরুকেন্দ্রিকও হতে পারে এবং মানুষজনকে দাওয়াত দেওয়া যেতে পারে।
ঙ, এটাকে বহু সওয়াবের কাজ রূপে প্রচার না চালানো। বরং অন্যান্য দরসের মতো এটিও একটি সাধারণ দরস- এটা নিজে বুঝা ও জনগণকে বুঝানো। নামাযের ইমাম বড় আলিম হলে সওয়াব বেশি হবে-এমন কোনো কথা নেই। হাঁ, এ উপলক্ষে দুআ করা, মিষ্টি বিতরণ করা ইত্যাদিতে কোনো অসুবিধা নেই। সালাফের মধ্যে কিতাবপড়া শেষ করে এটাকে সৌভাগ্য জ্ঞান করে খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করার রেওয়াজ ছিল।
সারকথা, খতমে বুখারীর নানাদিক রয়েছে। কিছু দিক আপত্তিকর। কিছুদিক উপকারী। উপকারের দিক বেশি মনে হয়। মন্দকে পরিহার করে এ জাতীয় দরস হলে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। বিদআত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আল্লাহই সবর্জ্ঞ।