তাদের পেছনে এতো এতো পরিশ্রম, এতো এতো দাওয়াত, এতো এতো সতর্ক করার পরেও তারা সু-পথে আসছে না। আল্লাহর দিকে ঝুঁকছে না। মহান মালিক আল্লাহর অবাধ্যতা—শিরক, কুফর পরিত্যাগ করছে না। তা করার কোনো লক্ষণও তাদের মাঝে দেখা যাচ্ছে না। এদের এহেন হঠকারিতায় অন্তরে ভীষণ ব্যথা পেলেন তিনি। হলেন আশাহতও। সর্বশেষ সময়ে তাদেরকে আবারও চিরন্তন মুক্তি ও কল্যাণের পথে আহবান করলেন। এবং বললেন—তিন দিনের ভেতর যদি তারা আল্লাহর আনুগত্যের শামিয়ানায় শামিল না হয়, তা হলে তাদের ওপর আজাব নেমে আসবে। ধব্বংসের দেয়াল তাদের ওপর খসে খসে পড়বে। তারা পর্যুদুস্ত হয়ে যাবে। বিনাশ হয়ে যাবে।
[ইবনে কাসির-১৪তম খণ্ড]
দিনগুলো যাচ্ছে যথারীতি। আর মাত্র একদিন বাকী। তারা তখন অবধি ছাড়েনি কুফুরির পথ। ধব্বংসের দেয়াল তাদের ওপর হুড়মুড় করে পড়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র ! তাই তিনি আগের দিন রাত্রিতে ( দুইদিন অতিবাহিত হবার পর) সেই জনপদ ত্যাগ করেন, অন্যত্র পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে।
[ নবীদের সংগ্রামী জীবন-১৮৫]
যেতে যেতে অনেক দূর গেলেন। সামনেই ফোরাত নদী। উঠতে হবে নৌকায়। উঠলেনও তিনি। চলতে লাগলো নৌকাটি। কিছু দূর যাবার পর প্রবল ঝড়-তুফান আসে। এতে নৌকাটি ডুবে যাবার লক্ষণ প্রকাশ পায়। কী করা যায় এখন— সকলেই ভাবছে। তারা ভীতসন্ত্রস্ত-চিন্তিত। একপর্যায়ে সকলেই মিলে ঐকমত্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, নৌকার ভার হালকা করতে একজনকে নৌকা হতে ফেলে দিবে। সেজন্য লটারির আয়োজন করা হলো। লটারিতে বারংবারই তাঁর নামই আসে। বারংবার…। পবিত্র কালামুল্লাহ মাজিদে বিষয়টি এভাবেই এসেছে যে,
“সে লটারিতে যোগদান করলো এবং পরাভূত হলো”।
[সূরা আস-সাফফাত: ১৪১]
অবশেষে তাঁকে নৌকা থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া হলো। তিনি নৌকা থেকে নদীতে পতিত হবার সাথে সাথেই একটা বিরাটাকার মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেললো। কিন্তু হজম করলো না।
[ইবনে কাসির-১৪তম খণ্ড]
তিনি আল্লাহঁর নির্দেশনা আসার পূর্বেই নিজ জনপদ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এইজন্য যে— তিনি ভেবেছিলেন তাদের ওপর আল্লাহর যে আজাব আসবে, তাদের সাথে তিনিও আল্লাহর সে আজাবে ঘেরাও হবেন , তাঁর পাকড়াও থেকে তিনি রেহাই পাবেন না; সে কারণে তাঁর কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেওয়া উচিত বলে মনে করেই তিনি নিজ জনপদ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।
[ তাফহীমুল কুরআন-সুরা আম্বিয়া; টিকা-৮৪ ] কিন্তু আল্লাহর এটা পছন্দ হলো না। তাঁর শান-মানের সাথে এমনটি মানানসই ছিলো না। যার জন্য আল্লাহ তাঁকে মাছের পেটের অন্ধকারে বন্দী করলেন ! এই যে মাছের পেটে বন্দী অবস্থা তাঁর , এটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিলো না। বরং এর উদ্দ্যশ্য ছিলো আদব শিক্ষাদান। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ [তাফসীরে কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭]।
যার কারণে মাছটি তাঁকে খেলো না। ভাঙলো না তাঁর হাড়-ও।
হ্যাঁ, যাঁর এবং যাদের কথা বলেছিলাম তিনি হলেন আল্লাহর নবি ইউনুস বিন মাত্তা আলাইহিস স্বলাতু আসসালাম, ও তাঁর কওম! তিনি জন্মেছেন সিরিয়ায়। কিন্তু নবি হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন আসিরীয়বাসীর নিকট, তথা বর্তমান ইরাকের মুসেল শহরের বিপরীত পাশে নীনওয়া নামক তৎকালীন বিখ্যাত নগরীতে।[ তাফহীমুল কুরআন-সুরা ইউনুস-৯৮] পবিত্র কুরআনুল কারিমে ওনাকে কখনো যূন-নুন, কখনো স্ব-হিবুল হুত কখনো-বা ইউনুস* নামেই সম্বোধন করা হয়েছে।
যাইহোক, ইউনুস আলাইহিস সালাতু আসসালামের জাতির ওপর আল্লাহ আর আজাব দিলেন না। কারণ তাদের নবি তাদের ছেড়ে চলে যাবার পরে ভীষণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহর আজাবের ভয়ে, নবির কথা অমান্য করার অনুতাপে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করতে লাগলো তারা । গবাদি পশু-পাখি নিয়ে কেউ কেউ আশ্রয় নিলো পাহাড়ে। গহীণ জঙ্গলে। তারা সেখানে গিয়ে শিশুদের এবং গবাদিপশুগুলোকে পৃথক করে আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলো । অনুতাপের অশ্রু ঝরিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করলো। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিলেন। মাফ পেলো তারা।
এদিকে তাদের পয়গম্বর আল্লাহর নবি ইউনুস আলাইহিস স্বলাতু আসসালাম মাছের পেটে। বন্দী তিনি। তাবৎ দুনিয়ার সব আলো বাতাস হতে বঞ্চিত । চরম ঘুটঘুটে অন্ধকারে আবৃত। মাছের পেটের অন্ধকার। গভীর সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার। রাত্রির অন্ধকার —তিনস্তর বিশিষ্ট অন্ধকারের আবরণে আবৃত তিনি। মাছের পেটে থাকাকালীন তিনি বুঝতে পারেন এভাবে নিজ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত জনপদ ছেড়ে আসা তাঁর ঠিক হয় নি। তিনি আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করতে লাগলেন। মাছের পেটেই সিজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে চেয়ে অনর্গল অশ্রু ঢালতে লাগলেন। আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন। মাছের পেট থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। পবিত্র কালামুল্লাহতে বিষয়টা এভাবেই এসেছে —
“আর মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে (আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তার উপরে কোনরূপ কষ্ট দানের সিদ্ধান্ত নেব না। ‘অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমা লংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি”
[আম্বিয়া ২১/৮৭-৮৮]
আল্লাহর হুকুমে ইউনুস আলাইহিস স্বলাতু আসসালাম সেই বিরাটাকার মাছের পেট থেকে নদীতীরে নিক্ষিপ্ত হন। যেহেতু তিনি মাছের পেটে ছিলেন, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই তিনি রুগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ঐ অবস্থায় যেখানে তিনি নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, সেখানটায় ছিলো না কোনো তরুলতা। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে—
অতঃপর আমি তাকে নিক্ষিপ্ত করলাম এক তৃণহীন প্রান্তরে, এবং সে ছিলো রুগ্ন।
[ সূরা আস-সাফফাত: ১৪৫]
এরপর আল্লাহর রহমতে সেখানে একটি লাউ জাতীয় গাছের জন্ম হয়। তিনি সে গাছের পাতা খেয়েছিলেন, যা ছিলো প্রবল পুষ্টিসমৃদ্ধ। [ নবিদের কাহিনী-ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহিল গালিব]
ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ সুস্থ হয়ে ওঠেন। আল্লাহর হুকুমে প্রত্যাবর্তন করেন নিজ কওমের নিকট। তারা তাঁকে পেয়ে ভীষণ খুশি হলো। তাঁর ওপর ঈমান আনলো। যার ফলে আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে দুনিয়াতে ধন্য করেন। এবং দুনিয়াকে বৈধভাবে ভোগ-বিলাসের সুযোগ দেন। পুনরায় শিরকী কর্মকাণ্ডে আবার লিপ্ত হলে তাদের পতন হয়।
আল্লাহর দুনিয়ায় এই জাতি-ই একমাত্র জাতি; যারা আজাব আসার পূর্বক্ষণে ঈমান আনে, এবং আল্লাহ রব্বুল আলামিন-ও তাদের সেই ঈমান এবং তাওবা কবুল করেন। এই বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা বলেন—
“এমন কোনো দৃষ্টান্ত আছে কি যে, একটি জনবসতি চাক্ষুষ আজাব দেখে ঈমান এনেছে, আর সে ঈমান তাদের উপকারে আসছে? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনলো, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আজাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম”
(ইউনুস ১০/৯৮)।
এখানে একটা বিষয় খুব সুস্পষ্টভাবেই লক্ষণীয় যে, আল্লাহর নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম এবং তাঁর জাতি; উভইয়েই কিন্তু আল্লাহর ক্ষমা আর মেহেরবানী পেয়ে ধন্য হয়েছেন। তাঁর জাতি নিজেদের অপরাধ উপলব্ধি করে, নিজেদের ভুল বুঝে, আল্লাহ এবং তাঁর নবির আদেশ লঙণ করার অন্যায়ের অনলে দগ্ধ হলো তাদের নিজেদের বিবেক। তাই তারা ভীতকম্পিত কণ্ঠে খাঁটি দিলে আল্লাহর নিকট তাওবা করলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন। মুক্তি দেন। এবং ইউনুস ইবনে মাত্তা আলাইহিস সালামও আল্লাহর আদেশের পূর্বে নিজ কওমকে ছেড়ে চলে যাবার ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে কাতর স্বরে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চান। নিজে নিজের ওপরই জুলুম করেছেন বলে রব্বের দরবারে স্বীকৃতি দেন। কাকুতি-মিনতি করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকেও তাঁর অপার করুণায় ক্ষমা করেন।
তিনি শুধু একটি ভুল করেছেন। আর সেই ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে কী অপরিসীম বিনয়সহ তাওবা করেছেন যার কারণে পবিত্র কালামুল্লাহতেও বিষয়টার আলোকপাত হয়েছে। আল্লাহর কাছে তাঁর তাওবার বাক্যটি এতো অধিক-ই পছন্দ হয়েছে যে, সে-জন্য এই বাক্য পড়ে যদি কেউ তাওবা করে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন। কবুল করবেন তার প্রতিটি নেক দু’আ। আর ইউনুস আলাইহিস সালামের এই দু’আ বিশ্বের সকল বিশ্বাসী বান্দার নিকট দু’আয়ে ইউনুস নামে পরিচিত। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম বলেন—
‘বিপদগ্রস্ত কোন মুসলমান যদি (নেক লক্ষ্য হাসিলের নিমিত্তে) উক্ত দু‘আ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তা কবুল করেন’।
[তিরমিযী হা/৩৭৫২]
আমরাও তো ভুল করি। অন্যায় করি। হররোজ আল্লাহর আদেশের অবাধ্যতা করি। আমরাও যদি এভাবেই ভুলের স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহর কাছে কাছে ক্ষমা চাই, অপরাধ হতে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি; তা হলে আমাদের আল্লাহ আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। তবে শর্ত হলো আমরা আল্লাহর আদেশ ডিঙ্গিয়ে, তাঁর হুকুম লঙ্ঘন করে নিজেদের ওপর যে জুলুমের জোয়াল চাপিয়েছি —সেটার স্বকৃতি দিয়ে ,নফসের ওপর জুলুমের যেই জোয়াল পরেছি ; তা খুলে ফেলে দিয়ে, পাপ থেকে চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নেবার সু-দৃঢ় প্রতিজ্ঞা খাঁটি দিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে। পবিত্র কুরআনুল কারিমের ভাষায় তাওবাতুন নাসুহা তথা তাওবার মতো তাওবা—খাঁটি তাওবা করতে হবে। এই তাওবার ফলাফল কী? তা আল্লহ রব্বুল আলামিন নিজেই বর্ণনা করেছেন তাঁর কালামে পাকে।
আল্লাহ পাক বলেন—
“ হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কার—প্রকৃত তাওবা; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত”।
[আল কুরআন-৬৬/৮]
এছাড়াও আরো একটা বিষয় হলো আমরা তো নানাবিধ বিপদ-আপদে নিপতিত হই-ই। নিত্যদিন-ই কোনো না কোনো বিপদের বিমান আমাদের ওপর ক্রাশ হয়। আমরা সেই বিপদ থেকে উদ্ধার হতে আল্লাহর দরবারে দু’আয়ে ইউনুস পড়ে দু’আ করতে পারি। ইন শা আল্লাহ আমাদের কবুল করে তাঁর রহমতের কোলে আশ্রয় দান করবেন।
জুলুমের স্বীকৃতি—ক্ষমা পাবার পূর্ব শর্ত-০১