সাধারণত দ্বীনি জ্ঞান আছে, নিয়মিত মসজিদে নামাজে যান, নেতৃত্বের যোগ্যতা আছে এমন মানুষজনই মসজিদ কমিটিতে স্থান পাবার কথা। কিন্তু, এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মসজিদে।
একটি গ্রামের একজন আলেম থাকলে দেখা যায় যে, তিনি অন্য কোথাও ইমামতি করেন বা মাদ্রাসায় পড়ান। গ্রামে কম থাকেন। সেই হিশেবে মসজিদ কমিটিতে সময় দেবার মতো সময় তাদের থাকে না। স্বভাবতই, মসজিদ কমিটিতে দ্বীনি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষজন কম দেখা যায়; এটা একটি নেতিবাচক বাস্তবতা।
এই লেখাটি যারা পড়বেন, বেশিরভাগই মসজিদ কমিটিতে কে আসবে সেটা নির্বাচন করার দায়িত্বে নেই। যেমন: গ্রামের প্রাজ্ঞ মুরব্বী, তার কথায় কমিটিতে লোক নির্বাচন হয় এমন কেউ এই লেখাটি পড়ছেন না। সেজন্য কেমন লোককে নির্বাচন করবেন এমন আলোচনা না করে আমি ভিন্ন আলোচনা করবো।
আমাদের অনেকের মধ্যে মসজিদ কমিটির প্রতি একধরণের ক্ষোভ কাজ করে। মসজিদ কমিটি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যায়।
মানুষ মনে করছে, মসজিদ কমিটিতে অযোগ্য লোক দ্বারা ভরে গেছে, তারা নিয়মিত নামাজ পড়ে না, কোনো যোগ্যতাই নেই। তাহলে, এসব কথা যে মনে করছে/করছেন, সে বা তিনি বসে আছেন কেনো?
আমরা রেডি-মেইড কিছু পেতে চাই। রেডি-মেইড পরিবার, রেডি-মেইড সমাজ, রেডি-মেইড রাষ্ট্র। খুঁজে খুঁজে দেখবো অমুক ঠিক নেই, তমুক ঠিক নেই। কিন্তু, নিজে নিজের পরিবারকে ‘ঠিক’ করা, নিজের সমাজকে ঠিক করার কোনো উদ্যোগ নিতে চাই না। মসজিদ কমিটিতে যারা আছে তারা যদি অযোগ্য হয়, তাহলে আমি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ঘরকুনো হয়ে আছি কেনো?
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবি করে, বলে নেতৃত্ব নিতে নিষেধ করেছেন। অন্যদিকে, ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) মিসরের ফিন্যান্স মিনিস্টার হবার জন্য নেতৃত্ব চান। এই দুটো বিষয়কে আলেমগণ এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে:
“যখন এমন কোনো পরিস্থিতি দেখা দেয় যে, নেতৃত্ব অযোগ্যের হাতে যেতে পারে, তখন নিজে যোগ্য থাকলে নেতৃত্বের দাবি করা যেতে পারে।”
আপনার মসজিদে যদি মনে করেন অযোগ্য লোক কমিটিতে আসতে পারবে, তখন আপনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন। আপনি মসজিদের বিষয়াদিতে কথা বলুন, ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে যেসব সেবামূলক কাজ করা যায়, সেসবে নিজেকে নিযুক্ত রাখুন। ২-৪ বছর পর এমনিতেই আপনাকে কমিটিতে স্থান দেয়া হবে। কিন্তু, আপনার কাজগুলো হতে হবে ভিশনারী নিয়ে। লক্ষ্য থাকতে হবে অটুট। মসজিদ কমিটিতে গিয়ে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখার নিয়্যতে এটা করবেন।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য স্রেফ একটি মসজিদ কমিটিতে নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে পারেন না, নিজের সমাজের লোকজন আপনাকে কেয়ার করছে না; তাহলে কিভাবে আশা করেন রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে কথা বললে আপনাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেয়া হবে?
রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে সারাদিন ফেসবুকে তত্ত্ব আউড়িয়ে মসজিদ কমিটিতে নিজের যোগ্যতা আর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছেন না?
তাহলে ভাবা দরকার আপনি কুসুম কুমারী দাসের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার ‘কথার ছেলে’ নাকি ‘কাজের ছেলে’।
মসজিদের ফান্ডের দিকে নজর দিতে হবে। মসজিদ যদিও নন-প্রফিট অরগানাইজেশন, কিন্তু মসজিদের আয়ের উৎস অনেক। সাধারণ মুসল্লীদের দান, মাসিক চাঁদা, মসজিদের ফল-ফসল বিক্রি ইত্যাদির মাধ্যমে মসজিদের আয় হয়। আপনি কমিটিতে যাওয়া মানে, এই দিকটাতে নজর দেয়া। মসজিদের আয়ের খাত কিভাবে বাড়ানো যায়। সপ্তাহে বা মাসে একদিন সাধারণ দানের জন্য মুসল্লীদের আহ্বান জানাতে পারেন। তখন দানের ফযিলত সংক্রান্ত আয়াত/হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে পারেন।
আপনি যদি ক্যাশিয়ার হোন, তাহলে হিশাব খুব যত্ন সহকারে করার চেষ্টা করবেন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখবেন। প্রত্যেক সপ্তাহে বা প্রত্যেক মাসে জুমুআর নামাজ শেষে আয়-ব্যয়ের হিশাব মুসল্লীদেরকে দিন। ব্যয়ের ক্ষেত্রে রিসিট ব্যবহার করুন। দায়িত্বের মেয়াদ শেষে আয়-ব্যয় নিরিক্ষণের জন্য একজন অডিট নিয়োগ করুন।
সমাজের যেসব পেশাজীবী আছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পান একজন ইমাম সাহেব। সমাজের একজন দিনমজুরের চেয়েও তার বেতন কম হয়! আদর্শ মসজিদের স্বপ্ন দেখলে ইমাম সাহেবকে দেয়া বেতনটাও ‘আদর্শ’ (স্ট্যান্ডার্ড) হতে হবে।
গ্রামাঞ্চলের মসজিদের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় একজন ইমাম সাহেবের আদর্শ বেতন স্কেল হওয়া উচিত একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের স্কেলের সমান। গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ মসজিদে একজন ইমাম সাহেবের বেতন থাকে একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের অর্ধেক! শিক্ষকের মাসিক বেতন ১২,০০০-১৫,০০০ থাকলে ইমাম সাহবের বেতন থাকে ৬,০০০-৭,০০০। এই বেতন বৈষম্য নিয়ে মসজিদ কমিটির সচেতনতা দরকার।
সমাজের অনেক মানুষ আছে দরিদ্র। তারা পরিকল্পিতভাবে আর্থিক সহযোগিতা পায় না। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় বায়তুল মালের কনসেপ্ট আমরা জানি। এটা চাইলে আমরা ছোট্ট পরিসরে সমাজেও বাস্তবায়ন করতে পারি।
গ্রামের অনেকেই যাকাত দেন, কিন্তু পরিকল্পিতভাবে দেন না। মসজিদ কমিটির উদ্যোগে গ্রামে একটি যাকাত ফান্ড হতে পারে। এই ফান্ডের আওতায় যারা যাকাত দেয়, তারা স্বেচ্ছায় সেই ফান্ডে যাকাত দিবে। যাকাতের টাকাগুলো গ্রামের গরীব লোকদের মধ্যে এমনভাবে বিতরণ করতে হবে, যাতে সেই টাকা দিয়ে তারা দারিদ্র বিমোচন করতে পারে।
যাদের উপর যাকাত ফরজ, তারা অনেকেই এটা বুঝতে পারে না। এই ব্যাপারেও মসজিদ কমিটি সেমিনারের আয়োজন করতে পারে। যাতে সমাজের ধনী লোকেরা সচেতন হয়। যাকাত ফান্ডের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা থাকলে সবাই আগ্রহী হবে এই প্রকল্পে। ফলে দরিদ্র কেউ এককালীন ১ লক্ষ টাকা পেলে বা একটি রিক্সা/সিএনজি/দোকান পেলে দুই বছর পর তার আর যাকাতের টাকার প্রয়োজন হবে না।
পরিবার-সমাজ পরিবর্তন না করে রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন আশা করতে পারেন না। আপনি আশা করবেন দেশে ইসলাম কায়েম হয়ে যাবে, অথচ আপনি সমাজে কোনো ধরণের উদ্যোগ নিবেন না, বসে থাকবেন আর ভুল ধরবেন; এমন তো হবে না।
আরেকটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের কথা বলি। এটা এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে এমন না। তবে আপনি মাথায় রাখতে পারেন। ১০-১৫ বছর পর আপনি যখন মসজিদ কমিটির সভাপতি/সেক্রেটারি হবেন, তখন এই প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন।
বেশিরভাগ মসজিদে ইমাম সাহেব থাকার জন্য যে হুজরা থাকে, সেটা পরিকল্পিতভাবে বানানো যেতে পারে। সার্বিক সুব্যবস্থা থাকলে সেখানে মসজিদের ইমাম সাহেবকে তার পরিবার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ইমাম সাহেব সাধারণত মাসে ৩-৪ দিন বাড়িতে গিয়ে ছুটি কাটান। এটার অনেক সমস্যা আছে।
মসজিদের হুজরা যদি আলাদা থাকে, রান্না করার সুব্যবস্থা থাকে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এটা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্ল্যান করতে পারেন। এই ধরণের ব্যবস্থা দুই-এক বছরের মধ্যে হবে না। সমাজের মানুষের মানসিক অভ্যস্ততার ব্যাপার আছে।