রাত বারোটা কি একটা হবে! ঘড়ির দিকে তাকানোর ফুসরত হয়নি, চারদিকের সবকিছুই যেন ঝাপসা হয়ে আসছিলো সেদিন। সেদিনের সেই গল্পটা ছিল ঠিক এমন –
এশার সালাতের ইমামতি করছিলাম। সুরা ফাতিহা পাঠ করার পরে কি সূরা তিলাওয়াত করব সেটা নিয়ে মনে দোদুল্যমানতা কাজ করতেছিল।
কি মনে করে হঠাৎ করেই, তিলাওয়াত শুরু করলাম –
সুরা সূরা মুযযামমিল। শুরু করলাম –
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ
হে চাদর আবৃতকারী!
প্রথম আয়াত তিলাওয়াতের পর কেমন জানি মনে হল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাকে ডাক দিলেন-
“হে বস্ত্র আচ্ছাদনকারী ” বলে।
রবের ডাকে,
অজানা এক পুলক,মহান রবের সান্নিধ্যের অনুভূতি মসজিদের আঙিনায় সদ্য ফোটা হাসনাহেনার ঘ্রাণে এক জান্নাতি পরশ অনুভব হলো।
তার পর দ্বিতীয় আয়াত-
قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا
রাতে সালাতে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া।
তিলাওয়াতের পর মনে হলো আল্লাহ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন শেষ রাতে রবের ডাকে সাড়া দিতে। এশার সালাত হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সালাত শেষ করে তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে গেলাম। শেষ রাতে রবের সান্নিধ্যের অনুভূতি লাভের জন্যে। এশার সালাত আদায়ের পর,অল্প সময়ের ভিতরেই সেদিন শুয়ে পরেছিলাম।
শীতের আগমন অনুভব হচ্ছিল।
শীতের স্পর্শ শরীরে অনুভব হওয়ার পর থেকেই অজানা এক আনন্দ অনুভুত হচ্ছিল সেই সময়টাতে। শীতকালের প্রতি আমার অন্তর থেকে একটা টান ছিলো। শীতকালে রাত অনেক দীর্ঘ হয়, দীর্ঘ রাতে ইবাদাত করার সুযোগ পাওয়া যায়, একাগ্রচিত্তে রবের সান্নিধ্য অনুভব করা যায়। যৌবনে যখন মাদ্রাসার তালেব( ছাত্র) ছিলাম, শীতের রাতে ফজর নামাজের আগে উঠে যেতাম তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের জন্যে। কিয়ামুল লাইল শেষে ফজর আদায় করে পড়াশোনা শুরু করতাম। সেই যৌবন থেকেই শীতকালকে আমার বসন্তকাল মনে হতো!
বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ করে বুকটা চিনচিন করে ব্যথা শুরু হলো। রাত নয়টায় ব্যথা শুরু হয়েছিল, ঘন্টাখানেক পরে প্রাথমিক কিছু ঔষধ খেয়েছিলাম কিন্তু কোনো কাজ হয়নি তখন। এভাবে রাত ১২ টা পর্যন্ত যাওয়ার পর ব্যথার মাত্রা এত বেশি বেড়ে গেছে যে কাউকে ডাকার সামর্থ্য টুকু ছিলোনা সেদিন। মাঝরাত হওয়াতে সবাই ঘুমিয়ে পরেছিলো। প্রচন্ড বুক ব্যথার মাঝেও রবের সেই ডাক কানে বাজতেছিল –
” হে বস্ত্র আচ্ছাদন কারী “!
মূহুর্তের ভিতরে মনে হতে লাগলো রব আমাকে চিরস্থায়ী জগতের দিকে আহবান করছেন। ততক্ষণে আমার চিন্তাশক্তি লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়ে দাড়ালো। এক দিকে রবের সুমহান আহবান অপরদিকে দুনিয়াবি ব্যস্ততা। বারবার মনে হয়ে যাচ্ছিলো পরকালীন যাত্রার জন্যে আমার অপূর্ণ প্রস্তুতির কথা! চোখের দুইপাশ দিয়ে পানি পরতেছিলো, দুনিয়াতে করা ভুলের ফিরিস্তি চোখের কোণে ভেসে ভেসে উঠতেছিলো। বারবার আফসোস হচ্ছিলো নিজের প্রতি, হায় আমি যদি সেদিন সেই কাজটি না করতাম তাহলে হয়তো আজ এই অপ্রস্তুত অবস্থায় রবের সামনে দাড়াতে হতোনা! অপরদিকে মনে হচ্ছিলো রব আমাকে চিরস্থায়ী শান্তির দিকে আহবান করছেন।
যৌবনের ইবাদাত গুলো বারবার মনে পরছিলো। মনে হচ্ছিল শীতের রাতের তাহাজ্জুত নামাজ গুলো ( যা আদায় করতাম আল্লাহর আরশের নিচে জায়গা পাওয়ার লোভে) আমাকে শান্তনা দিচ্ছে !
চোখে (যে চোখ কে আল্লাহর হুকুমে অবনত রেখেছিলাম যৌবনে) ভেসে উঠতেছিলো জান্নাতের সবুজ পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য। মনে পড়তেছিলো প্রিয় সহধর্মিণীর কথা,প্রিয় আকরামের কথা। যাদেরকে আল্লাহ তালার জিম্মায় রেখে যাওয়া ছাড়া আমার উপায় ছিলোনা। বুক ব্যথার মাত্রা এত বেশি হয়ে গিয়েছিল মনে হচ্ছিল আর কিছুক্ষণ,
আর কিছুক্ষণ –
তারপরেই মহান রবের সান্নিধ্য!
হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু তখনও অনেক দায়িত্ব বাকি ছিলো।
দস্তুরমতো চেষ্টায় দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে ওঠে বসেছিলাম।
জান্নাতের লোভ আমার বুক ব্যথাকে হার মানিয়েছিল সেদিন!
মসজিদের যাবতীয় আর্থিক হিসাব শেষ করলাম প্রচন্ড বুকব্যথা নিয়ে, কাউকে খোঁজে পাচ্ছিলাম না, কেউ সজাগও ছিলো না হিসাবটুকূ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে-
যেন মহান রবের নিকট হিসাবের বোঝা দীর্ঘ না হয়!
কাউকে ডাকার শক্তিটাও ছিলোনা,বারবার মনে হচ্ছিলো মহান রব হয়তো আমাকে এই অপূর্ণ অবস্থাতেই তার অতিথি করার ইচ্ছা করেছেন! মসজিদের প্রিয় আঙ্গিনাটাকে শেষবারের মত দেখার জন্যে, যেখানে গত ত্রিশ বছর কাটিয়েছি, জানালার শিকগুলোকে ধরে এগিয়ে গেলাম। মসজিদের সামনে যেতেই আমার পূর্ববর্তী ইমাম লাতালি মুন্সির কবরটা চোখে পরলো।
চারপাশে মোজাইক করা কবরের ঠিক মাঝখানের হাসনাহেনা ফুল গাছটা চারিদিকে সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। মনে পরে গেলো মনের গহীনে জমে থাকা সেই শেষ বাসনার কথা! যা শুধু মহান রবের নিকট কেঁদে কেঁদে বলতাম!
বলতাম –
” ইয়া রব, কোনো এক,
কুয়াশাচ্ছন্ন পূর্ণিমার রাতের ফজরের ওয়াক্তে তোমার মেহমান করে নিও এই পৃথিবী থেকে “!
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে মনে হলো ‘কুয়াচ্ছন্ন পূর্ণিমার রাতে’ এই পৃথিবী ছেড়ে অনন্তকালের যাত্রার সেই ইচ্ছা বোধয় পূরণ করবেন না মহান রব!
এটাই মনে হয় ছিল তার সিদ্ধান্ত! আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমার সদ্য বিদায়ী ছাত্র হেলাল এগিয়ে আসল, তাকে ইশারায় বুঝালাম আমার প্রথম জীবনের ছাত্র আক্তার হোসেনকে, যে কিনা আমার অনুপস্থিতিতে ইমামমতি করে আমার জায়গায়, ডেকে আনতে বলি।
বুকের ব্যাথাটা আরো বেড়ে গিয়েছিল ততক্ষণে! মুখ থেকে কথা বের হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, হাতের ইশারায় আকতারকে হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।
হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই মহান রবের একটি কথা মনে পরে গেলো ঃ-
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا
নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে।
[সূরা আশ-শামসঃ৯]
মনে হচ্ছিলো মহান রবের আহবানে সাড়া দেওয়াতে আর কোনো বাধা নেই!
তারপর –
তারপর আর কিছু মনে নেই!
ঘন্টা দুয়েক পরে দেখলাম আমি ডাক্তারের কাছে!
আমার ছাত্ররা আমাকে নৌকায় করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো।
সেদিনের মত আমাকে ফিরিয়ে দিয়িছিলেন মহান রব!
আমাকে সবুজ পাখিদের দলে উড়ে বেড়ানোর সৌভাগ্য, মহান রব সেদিন উপহার দেননি। রাত তিনটার দিকে ডাক্তারের কাছ থেকে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে, পাঞ্জাবির হাতলটাতে সামান্য সুগন্ধি লাগিয়ে তাহাজ্জুতের সালাতে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি আমার চারপাশে মেশকের সুভাস অনুভব করলাম সেদিন! তাহাজ্জুতের সালাতে দাঁড়িয়ে গেলাম আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা দিয়ে! তারপর ধীরে সুস্থে তিলাওয়াত করলাম সূরা মুজজাম্মিল।
যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলছেনঃ-
১) হে বস্ত্ৰাবৃতকারী !
২) রাতে সালাতে দাঁড়ান, কিছু অংশ ছাড়া
৩) আধা-রাত বা তার চেয়েও কিছু কম।
৪) অথবা তার চেয়েও একটু বাড়ান। আর কুরআন তিলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে।
৫)নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি নাযিল করছি গুরুভার বাণী।