‘আরে সাদিক যে। হঠাৎ এখানে?
আমি কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে কাছে গিয়ে বললাম,
‘চাচা, আপনার কি একটু সময় হবে?
‘হুম হবে তো। আচ্ছা তুমি ভিতরে এসে বসো, কী আলাপ আছে শুনি।
‘না চাচা। আপনার সময় থাকলে আমার ছোট্ট ঘরটাতে একটু যেতে হবে। যাবেন?
লোকটা আগের চেয়ে দশ ডিগ্রি প্লাস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন জামেলা টামেলা হয়েছে কি সাদিক?
‘জ্বি, কিছুটা ওই রকমই।
এই মুহূর্তে যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতা হলো, সে বাড়ির মালিকের নাম জামশেদ হোসেন। তিনি খুবই উদার মানুষ। তা না হলে আমার মতো পরিচয়হীন একজন মানুষের সঙ্গে ওনার মতো একজন বিত্তশালী মানুষ এমন সহজজাত আলাপ করতেন না। তিন তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলাতে স্বামী-স্ত্রী এবং দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ওনার সংসার। প্রথম এবং তৃতীয় তলা ভাড়া দেয়া।
এই ভদ্রলোক বড় ধরনের ধার্মিক মানুষ। প্রতি ওয়াক্তে মসজিদের প্রথম কাতারে সালাত পড়েন। প্রথমদিকে আমি যখন এই এলাকার মসজিদে আসতে শুরু করি, তখন এই লোককে চিনতাম না। নিয়মিত হওয়ার পর ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর তো একবার চিল্লাও দিয়েছি ওনার সঙ্গে।
ভুবন জুড়ে আমি যে একা একটি নিঃস্ব প্রাণী, রব ছাড়া দ্বিতীয় কোন আশ্রয়ের জায়গা আমার নেই তা কেউ না জানলেও জামশেদ সাহেব খুব গভীর ভাবেই জানেন। জানার সঙ্গে উপলব্ধিও করেন। বাসায় ভালো কিছু করলে আমায় যেন তাতে একটু শরিক করতেই হবে ওনার। ব্যপারটা আমার কাছে খুবই লজ্জাজনক মনে হয়। কেননা আজো পর্যন্ত আমি ওনাকে কিছুই দিতে পারিনি, শুধুই নিয়েছি।
অনেকবার উনি ওনার বাড়িতে আমাকে যেতে বলেছেন। কিন্তু আমার সাহস হয়নি। ভাঙা বেড়া টপকে ইট পাথরের দেয়ালের সঙ্গে খাতির জমাতেও সাহস লাগে। সেই সাহসটা আমার ছিল না। তাই নানান অজুহাতে বারবার উপেক্ষা করতে হয়েছে। সম্পর্কটা আমাদের শুধু মসজিদ পর্যন্তই নিবৃত্ত। তবে অভিভাবকহীন আমি কিছু একটা করতে গেলে ওনাকে বলে তারপরই করতে যাই। এটা কেন করি ঠিক আমিও জানি না।
আজ অবশ্যি নিজে থেকেই কোন এক তাগিদে ওনার বাড়ি পর্যন্ত আমাকে চলে আসতে হয়েছে। জামশেদ সাহেব জানেন না যে আমি ওনার বাড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুসময় পার করলাম সামনে থাকা বাগান দেখে। কী সুন্দর ফুলের আয়োজন। যেন ফুলের বৃষ্টিতে বাগান ভেসে উঠেছে। মনে মনে ভাবছিলাম— আহ, এমন একটা বাগান যদি আমার হতো! সারাদিন বাগানের ভেতর বসে থেকেই কাটিয়ে দিতাম। বাতাসের সঙ্গে ফুলের সুভাষ পেয়ে বারংবার নিদ্রায় হারাতাম। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হলো, ‘তুচ্ছ মূল্যের এটা নিয়ে কী করব?
আমি তো বরং চিরস্থায়িটা চাই, যেটা কেবল জান্নাতেই পাওয়া যায়।
হঠাৎ এমন সময় জামশেদ সাহেব নিচে নামছিলেন। আমাকে দেখে খানিক চমকিত হলেন। অতঃপর ডেকে বললেন,
‘আরে সাদিক যে। হঠাৎ এখানে?
ছোট একখানা গলির ঠিক শেষ প্রান্তে এসে একচালা একটি টিনের ঘর। আমার বসবাস এ ঘরেই। এতিমখানা থেকে উঠে আসার পর থেকে এটাই আমার একমাত্র ঠিকানা।
জামশেদ সাহেব মাথা নুইয়ে ঘরে ঢুকলেন। পেছনে আমিও। চৌকিতে একজন কুচকুচে কালো বোরকাবৃত মেয়েলোক বসা। তার থেকে একটু দূরে আরো দু’জন পুরুষ। ওরা সেই এতিমখানা থেকে এসেছে, যেখানে আমি ছিলাম।
জামশেদ সাহেব আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি মুখ খুললাম,
‘ওনারা এতিমখানা থেকে এসেছেন, আমি যেখানে থাকতাম। উনি সবুর আহমেদ, আমরা সবুর চাচা বলতাম। এতিমখানার জিম্মাদার উনি।
‘সবুর চাচা উঠে দাঁড়িয়ে জামশেদ সাহেবের সঙ্গে সালাম মুসাফাহা করলেন।
বললেন,
‘সাদিকের সঙ্গে এই মেয়েটাকে বিবাহ দিতে চাই। মেয়েটাও ওর মতোই এতিমখানায় বড় হয়েছে। তবে মা-শা-আল্লাহ ধার্মিকতার দিক থেকে সে প্রায় অর্ধেকটাই সফল। এবার একজন যোগ্য পাত্রই তার বাকি অর্ধেক সফলতা এনে দিতে পারে। আর আমি মনে করি মেয়েটাকে সাদিকের সঙ্গে বিয়ে দিলেই বোধহয় সেটা সম্ভব। এতে দু’জনেরই খুব ভালো হবে।
জামশেদ সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়ে দেখেছ?
‘জ্বি না।
‘দেখে নাও, মেয়ে দেখে নেয়া তো সুন্নত।
‘চাচা, যেটা জানার ছিল সেটা হলো দ্বীনদারী। সেটা যেহেতু ঠিক আছে, তাহলে আর দেখার প্রয়োজন নেই। বরং উনি আমার এই ভাঙা ঘরে উঠতে পারবেন কি-না এবং রিজিকের সংকটে ধৈর্য ধরতে পারবেন কি-না এটা নিয়ে আমি শঙ্কিত।
সবুর চাচা বললেন, ‘এই বিষয়ে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো সাদিক। এই মেয়ে কী পরিমাণ ধার্মিক তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
জামশেদ চাচা বললেন,
‘মা-শা-আল্লাহ। আচ্ছা সাদিক, মহর হিসেবে দেওয়ার মতো কিছু আছে কি তোমার কাছে?
আমি মাটির একটা ব্যাংক এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘এইটা ছাড়া আর কিছুই নাই।
‘ওহ আচ্ছা, রেখে দাও তাহলে। জোহরের সালাত মসজিদে গিয়ে পড়ো, কেমন?
‘জ্বি আচ্ছা।
আমার পক্ষ থেকে জামশেদ চাচা বিয়ের অভিভাবক হলেন। তারপর পঁচিশ হাজার টাকা মহর ধার্য করে ছোট্ট সেই একচালাতেই খুব সাধারণভাবে বিয়েটা হলো আমাদের। মহরের টাকাটা দুপুর বেলা জামশেদ সাহেব আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোমার বিয়ে উপলক্ষে এটা আমার প্রথম উপহার।
বিয়ে পড়ানোর সময় বউয়ের নাম জানতে পারলাম আসমা। সুন্দর নাম। তারচেয়েও বেশি সুন্দর ওর ব্যবহার। খুবই কম কথার একটি মেয়ে। যেন হিসেব ছাড়া কোন কথা মুখ থেকে বের করে না। শুরুতে ওর কথা শুনে মনে হচ্ছিল কিছুটা ভয় পাচ্ছে। আমি সাহস দিয়ে বললাম,
‘তুমি কি এখানে ভয় পাচ্ছ?
অথচ আমি তোমার স্বামী।
কথাটা শোনার পর আসমা বুকভরে নিশ্বাস নিয়েছিল। যেন ভরসা করার মতো একটা কথা সে শুনেছে। তবে আসমা কথা বলে গ্রামের ভাষায়। ও হয়তো অনেকটা সময় গ্রামে থেকেছে।
আমাদের সংসারটা অভাবের হলেও ভালোবাসা ছিল কানায় কানায় ভরপুর। বিয়ের পর একদিন আসমা তার টাকাগুলো আমার হাতে দিয়ে বললো,
‘টেকাগুলা নিয়া দেহেন কিছু একটা করতে পারেন কি-না। এতগুলো টেকা দিয়া আমি কী করমু?
‘এগুলো তোমার টাকা। তোমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে খরচ করবা। রেখে দাও।
‘আমার টেকা কি আপনের টেকা না?
তাইলে নিতে মন্দ কী?
আর আমার লগে থাকলে দুইদিন পরে খুইজা পামু না। হারায়া যাইব। এর চাইতে টেকাগুলো আফনে কোন কাজে লাগায়া ফালান।
‘শুনো, মহাজনের বড় ছেলে এক্সিডেন্টে মারা গেছে বলে কিছুদিনের জন্য উনি ব্যবসা বন্ধ করে রেখেছেন। কয়দিন পর তো ঠিকি খুলবেন। তখন নিয়মিতই কাজে যেতে পারব। এখন কয়টা দিন অন্য কোথাও কাজ করে চলতে হবে। সমস্যা নাই তো ইনশা-আল্লাহ ।
কিন্তু নাহ, আসমা আমার কথা শুনলো না। সে জোর করে টাকাগুলো আমার হাতে দিয়ে বললো আমি যেন আগের জায়গায় আর কাজ করতে না যাই। বরং তার এই টাকাগুলো দিয়ে যেন ছোটখাটো একটা ব্যাবসা শুরু করি। অবশেষে বাধ্য হয়েই টাকাগুলো আমি নিলাম।
আর বিবির কথা মতোই বিসমিল্লাহ বলে বের হলাম এই ভেবে যে, দেখি এই অভাবীর তাকদিরে আল্লাহ কী লিখে রেখেছেন,,,,,
আসমানের আয়োজন
(পর্ব—১)