আসমানের আয়োজন (পর্ব—২)
ভাগ্যের উত্থান সুবাদে বিয়ের তৃতীয় দিনই নতুন একটা কাজ পেয়ে গেলাম আমি। সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরি, তখন খুব বৃষ্টি। ঘরে ঢুকলাম ভেজা শরীর নিয়ে।
আসমা এসে বললো, ‘অতো দেরি করলেন কেন? আসমান খারাপ দেইক্কাই আইয়া পরতেন!
‘আমি চাইলেই কি আর চলে আসতে পারব? কাজ শেষ করে আসতে হবে না?
‘যদি জ্বর-টর উডে?
‘রবের ফায়সালা হলে উঠবে, নাহয় উঠবে না। আর উঠলে উঠুক, জ্বর হলে গোনাহ মাফ হয় জানো না?
‘জানি। অহন কাপড়চোপড় গুলা তাড়াতাড়ি পাল্টায়া লন, শরীরটা মুছে দেই, নাইলে ঠান্ডা লাগব।
আসমা আমার শরীর মুছে দিচ্ছে। কী মিষ্টি একটা মেয়ে সে।
আমি ভাবছি,
এই ক’দিন আগেও যে মানুষটা আমাকে চিনতো না, যেই আমি তাকে কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না। সেই মানুষটাই আজ আমার কতো আপন। সে আজ আমাকে নিয়ে টেনশন করছে। আমার শরীর খারাপ হবে বলে চিন্তিত হচ্ছে। কতো সুন্দর করে আমার চুলদাড়ি মুছে দিচ্ছে। এই ভালোবাসার কি কোন সংজ্ঞা হয়?
হয় না।
কোন উপমাও হয় না এই প্রণয়ের। কিন্তু আমার ভাগ্যে এই আয়োজনটা নিঃসন্দেহে একটি চমকের মতো। যেখানে নিজেরই কোন পরিচয় নেই, সেখানে মনের মতো একজন দ্বীনদার বউ পাওয়া তো দূর কী বাত! কিন্তু আসমানের আয়োজন বলে কথা! আমাদের কল্পনা যেখানে চলতে পারে না সেখানেও চলে আসমানের ফায়সালা। এটাই ভাগ্যলিপি, এটাই তাকদীর।
রাতের খাবার ঘরেই রান্না হলো। শাক আর ডাল। বিয়ের আগে আমার ঘরে নিয়মিত কোনদিন রান্না হতো না। ঘর ঝাড়ু দেয়া তো দূরের কথা, ঘুম থেকে উঠে বিছানা যেমন রেখে যেতাম, পরের রাতে শুতে এসেও বিছানা ঠিক তেমনই পেতাম।
সেই অগোছালো ছোট্ট ঘরটা আজ আসমার স্পর্শে স্বপ্নের মতো রঙিন হয়ে উঠেছে।
আমি মাঝেমধ্যে চকিতে বসে আগের অগোছালো ঘরটা কল্পনা করতে চেষ্টা করি, কিন্তু পুরোপুরি পারি না। সুন্দর পরিবেশে অপরিচ্ছন্নতার চিন্তা করাও যায় না। করতে চাইলেও পারা যায় না।
ঘুমের আগে আসমাকে ডেকে বললাম,
‘এই নাও তোমার জিনিস, আগলে রাখো কাজে লাগবে।
আসমা টাকাগুলো হাতে না নিয়েই বললো, ‘আফনে না এইগুলা দিয়া কিছু করবার গেছিলেন?
‘নতুন একটা কাজ পাইছি। বড়লোক এক লোকের বাড়িতে বাগান পরিষ্কার করা, আর তিন চারটা গাড়ি আছে, সেগুলো ধুয়া। বেতন আট হাজার।
‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর ধারে অনেক অনেক শুকুর। কাজটা কেমনে পাইছেন?
‘জামশেদ চাচাই ব্যবস্থা করে দিছেন। উনি আসলে খুব ভালো একজন মানুষ। ধনী গরীবের কোন বৈষম্য ওনার কাছে নেই। সবাইকে মানুষ হিশেবে খুব গুরুত্ব দেন।
‘আল্লাহ তায়ালা ওনারে আরো বড়ো বানায়া দেওক।
‘আমীন। ওহ আসমা, মাটির ওই ব্যাংকটা একটু এদিকে আনো তো।
‘আনতেছি।
আসমা মাটির ব্যাংকটা এনে আমার হাতে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘জানো এটাতে কী আছে?
‘টেকা ছাড়া আর কী থাকব!
‘টাকা ছাড়াও আরো একটা জিনিস আছে।
‘কী আছে?
‘এখন বলব না। তবে ছোটকাল থেকে এখানে আমার একটা স্বপ্ন জমা করা হচ্ছে। যখন পূরণ করতে পারব তখনই জানতে পারবে।
‘তাই নাকি? পাগল মানুষ তো আফনে। কী এমুন স্বপ্ন, যেইডা বউয়ের কাছেও কওয়া যায় না?
‘আছে আছে। খুব ভালো স্বপ্ন।
‘ভালা স্বপ্ন! ও, আরো বিয়া-টিয়া করবার আশা আছে নাকি?
‘আরে নাহ, কী যে বলো না তুমি।
‘তাইলে কন না কী স্বপ্ন আফনের?
‘বললাম না, পূরণ করতে পারলে তখন বলব। ইন-শা আল্লাহ পূরণ হবে একদিন। তবে তোমার জন্য একটা চমক আছে।
‘কী চমক?
‘আমার স্বপ্নটাতে তুমারও অংশ আছে।
‘কী যে ঘুরায়া পেচায়া বিজ্ঞানীদের মতো কথা কন। আমার আবার কিয়ের অংশ?
‘আরে সত্যিই বলছি।
‘আইচ্ছা, তাইলে আমার একটা আশার কথা কমু?
‘কও
‘আফনের স্বপ্নত যদি আমার অংশ তাইক্কে তাহে তাইলে আমার টেকাগুলাও এই ব্যাংকে রাখবার চাই। দয়া কইরে না কইরেন না।
‘ঠিক আছে তুমি যদি চাও রাখতে পারো।
আসমা খুশিমুখে তার টাকাগুলো ব্যাংকে ভরে রাখলো। আমার স্বপ্নটা তার কাছে গোপনই রাখলাম। কারণ, আমার মতো মানুষ বউ নিয়ে একদিন হজ্ব করতে যাবে, এমন স্বপ্ন হয়তো বোকামিতেই পরে। এই স্বপ্ন আসমাকে বলে দিলে ও হয়তো বলবে, ‘কি বোকার মতো স্বপ্ন দেহেন। হজ্বে যাওন সাধারণ কথা না। অনেক টেকার ব্যাপার। এই কয়টা টেকায় হইতো না।
কিন্তু রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রওজার পাশে একটু সময় দাঁড়াতে কার না মন চায়? কার মনটা ব্যাকুল না হয় বাইতুল্লাহ’র তাওয়াফ করতে? হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে গোনাহমুক্ত হতে সবার মনই তো আনচান করে। করে না?
আমারো তো করে। আর এজন্য যদি আমি বোকা হয়ে থাকি, তাহলে আমি জীবনভর এমন বোকাই থাকতে চাই। আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু আমার মন তো আর গরীব না, তাই স্বপ্ন দেখতে তার কোন বাধা নেই।
তবে স্বপ্ন দেখেই যে বসে আছি এমনটাও না। এতোদিন যা কামাই করেছি তার থেকে কোনরকম চলা যায় পরিমাণ রেখে বাকিটা এই ব্যাংকে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় দিনে একবার খেয়ে থেকেছি, কখনো দুইবার খেয়েছি, কখনো অসুখে দুই এক রাত বিছানায় পরে ভুগেছি, তবুও ব্যাংকে হাত দেইনি।
এটা আমার বড় একটা কুরবানির ফসল। মহা বড় এক স্বপ্ন বাহী ব্যাংক। যে ব্যাংকে টাকার সাথে কিছু চোখের জলও পোষা হয়। সেই জলগুলো বাইতুল্লাহ এবং আমিরে হারামের রওযার সামনে অনেক বেশিই কাজে লাগবে।
একরাতে খাবার খাচ্ছিলাম। পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে আসমা। আমি একটু নরম স্বরে বললাম,
‘আসমা, আমার ঘরে আসার পর থেকে সত্যিই তুমি অনেক কষ্ট করে যাচ্ছো, যা তুলনাহীন। এই কষ্টের জন্য তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোন পথ বাকি নেই। আমার অল্প রোজগারের সংসারে তুমি খেয়ে না খেয়ে হাসিমুখেই দিন পার করছো, সবকিছু মানিয়ে নিচ্ছো। এটা আমার জন্য সত্যিই আনন্দের। কিন্তু আমি তোমার হক আদায় করতে পারছি না। তুমি আমাকে মাফ করে দিও।
আমার কথা শুনে আসমা দেখি হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছে। আমার বুকে মাথা গুঁজে কাঁদছে আর বলছে,
‘আমি সারা জীবন আল্লাহর কাছে খালি দ্বীনদার একজন মানুষ চেয়ে গেছি। আল্লাহ আমারে হের চাইতেও ভালো একজন স্বামী দিছে। আমার মতো ভালা কফাল আর কার আছে কন?
আর আফনের ঘরে আমি একটুও কষ্টত নাই। আমি অনেক খুশি, অনেক সুখী। আমার অতো কিছু চাই না বুচ্ছেন। আফনে সারাজীবন আমার কাছে থাকলেই হইবো, আর কিচ্ছু লাগব না আমার।
আসমা একটা কাপড়ের থলে এনে আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘এইহানে কতগুলো টাকা আছে।
‘কিসের টাকা?
‘আমি অনেকদিন থেইকা জমা করতাছি। জানেন আমার একখান শখ আছে।
‘কী শখ?
‘আফনেরে নিয়া হজ্বে যামু। হিহিহি
কথাটা বলেই আসমা একদণ্ড হেঁসে ফেলেছে। যেন মজা করে বলেছে কথাটা। কিন্তু আমি তো জানি, এ মজা না। এও আমার মতো একখান স্বপ্নের থলে, কিন্তু বোকা ভাববো বলে আসমা হেঁসে দিয়ে আমাকেই বোকা বানাতে চেয়েছে। আমার গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নেমে গেল।
তিন বছর পর,,,
ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটুকরো চাঁদের আলো এসে রংতুলির মতো আমার ছোট্ট সংসারটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। আমার সেই ফুটফুটে আলোর নাম আসমানি। নামটা রেখেছেন জামশেদ সাহেব।
জামশেদ সাহেব আজ খুবই ব্যস্ত। ওনার স্ত্রী’কে নিয়ে উনি হজ্বে যাচ্ছেন। তাদের বিদায় বেলা আমি আর আসমা ওনার বাসায় এসেছি। সাথে আসমানিও।
জামশেদ সাহেব যখন গাড়িতে উঠবেন, আমি তখন অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকালাম। মনকে বারবার শান্তনা দিতে দিতে বললাম,
‘আরে বেটা এতো কষ্ট কিসের? একটু ধৈর্য ধর, সময় একদিন তোকেও নিয়ে যাবে দেখিস। তোরাও যাবি একদিন মক্কায়। মক্কা থেকে মদিনায়। সাফা থেকে মারওয়ায় অনেক দৌড়াবি সেদিন। হাজরে আসওয়াদে চুমু খাবি। শুধু একটু ধৈর্য ধর, আর আসমানের ফায়সালার অপেক্ষা কর।
চেয়ে দেখি তাদেরকে বিদায় দিতে গিয়ে আমি কেঁদেই ফেলেছি। পাশে থাকা আসমাও কাঁদছে। কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না। আসমা কী ভাবছে জানি না।
আমি মনে মনে বলছি, ‘কাঁদুক সে, কেঁদে কেঁদে নিজেকে একটু শান্ত করুক। সেদিন আরো বেশি কাঁদতে হবে, যেদিন জানতে পারবে আর মাত্র এই ক’দিন পর সে আর আমি হজ্বে যাচ্ছি। সাথে আমাদের পুচকি আসমানিও। সেদিন তাকে অনেক কাঁদতে হবে, অনেক।
(দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব)
আসমানের আয়োজন