আসমাউল হুসনা – আন-নূর
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে আন-নূর — আলো, এবং উদ্ভাসক বলেছেন। তিনিই আলো এবং তাঁর থেকেই সমস্ত আলো উৎসারিত হয়। আন-নূর হলেন আসমান ও পৃথিবীর আলো, এবং তাঁর আলো শারীরিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ভাবেই প্রতীয়মান হয়।
আন-নূর ن-و-ر এর মূল থেকে এসেছে যা চারটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল আলো দেওয়া এবং উদ্ভাসিত করা, এবং দ্বিতীয় অর্থ হলো দৃশ্যমান করা বা প্রকাশ করা, এবং স্পষ্ট করা। তৃতীয় অর্থ হল জাজ্বল্যমান, প্রজ্জ্বলিত এবং ইন্দ্রিয়ের কাছে স্পষ্ট হওয়া এবং চতুর্থ অর্থ হল আলোকিত করা বা উপদেশ দেওয়া।
এই মূলটি কুরআনে ১৯৪ বার তিনটি উদ্ভূত আকারে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল ٱلنَّارَ – আন-নারা (আগুন), نُورُهُمْ – নুরুহুম (তাদের আলো) এবং مُّنِيرًا মুনিরাহ (প্রদীপ)।
ভাষাগতভাবে, নূর এমন কিছু নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয় যা আলো দেয়। উদাহরণস্বরূপ যা রশ্মির আকারে আলো দেয় এবং যা জিনিসকে দৃশ্যমান করে। আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল’ হলেন তিনি যাঁর দ্বারা সবকিছু দৃশ্যমান হয়, যাঁর বৈশিষ্ট্য হল নূর, এবং তিনিই আলোকিত করেন (মুনাউইর) এবং তিনি আসমান ও জমিনকে (হাদী) পথপ্রদর্শন করেন!
আন-নূর নিজেই বলেছেন –
ٱللَّهُ نُورُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ আল্লাহ আসমান সমূহ ও জমিনের নূর। [২৪:৩৫]
আল্লাহর নূরের প্রকৃতি কেমন?
কুরআন ও সুন্নাহতে আমরা আল্লাহ আজ্জা ওয়া জালের নূর (আলো) সম্পর্কে জানতে পারি যা তাঁর বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত। দৃষ্টি, জ্ঞান,শক্তির মত এটিও তাঁর অন্যান্য গুণাবলীর একটি। আন-নূর বলেছেন –
وَأَشْرَقَتِ ٱلْأَرْضُ بِنُورِ رَبِّهَا এবং পৃথিবী তার রবের নূরে আলোকিত হবে। [৩৯:৬৯]
এটি সেই বিশেষ এবং মহৎ মুহূর্তটিকে নির্দেশ করে যখন আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল কেয়ামতের দিন মানবজাতির বিচার করতে আসবেন।
আল্লাহর গুণাবলী এই নূর সম্পর্কে রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘আপনি নভোমন্ডল ও পৃথিবীর নূর’।[বুখারী]। তিনি আরো বলেন, ‘নূর হল আল্লাহ তা’আলার হিজাব (পর্দা), যদি তিনি তা উন্মোচন করেন তাহলে তাঁর চেহারার সুবুহাত (উজ্জ্বলতা ও দীপ্তি) তাঁর দৃষ্টি পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টিকে পুড়িয়ে ফেলবে।’ [মুসলিম]
আলেমগণ আল্লাহর নূরকে তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং গুণাবলী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই আলো তিনি তাঁর সৃষ্টিকে দিয়েছেন যেমন চাঁদ সূর্য, আবার মানুষকেও তিনি আধ্যাত্মিকভাবে আলোকিত করেছেন। সূরা নূরের ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল তাঁর নূরকে বর্ণনা করেছেন –
اَللّٰهُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ مَثَلُ نُوۡرِهٖ کَمِشۡکٰوۃٍ فِیۡهَا مِصۡبَاحٌ ؕ اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّهَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ زَیۡتُوۡنَۃٍ لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّ لَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ یَّکَادُ زَیۡتُهَا یُضِیۡٓءُ وَ لَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡهُ نَارٌ ؕ نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ یَهۡدِی اللّٰهُ لِنُوۡرِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰهُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ وَ اللّٰهُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ
আল্লাহ আসমান ও যমীনের আলো, তাঁর আলোর দৃষ্টান্ত হল যেন একটি তাক- যার ভিতরে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি হচ্ছে কাঁচের ভিতরে, কাঁচটি যেন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, যা প্রজ্জ্বলিত করা হয় বরকতময় যায়তুন গাছের তেল দ্বারা যা পূর্বদেশীয়ও নয়, আর পশ্চিমদেশীয়ও নয়। আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও তার তেল যেন উজ্জ্বলের বেশ নিকটবর্তী, আলোর উপরে আলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন স্বীয় আলোর দিকে পথ দেখান। আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করেন, আল্লাহ সর্ববিষয়ে অধিক জ্ঞাত।
[২৪:৩৫]
ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ এ নূরকে ব্যাখ্যা করেছেন আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল প্রদত্ত তাঁর মুমিন বান্দার হৃদয়ে আধ্যাত্মিক আলো হিসাবে। কুলুঙ্গিটিকে (জিনিসপত্র রাখার জন্য দেয়ালের মধ্যস্থিত ছোট খোপ) মুমিনের বুকের সাথে তুলনা করা হয়েছে; কুলুঙ্গির অভ্যন্তরে একটি গ্লাস রয়েছে, সবচেয়ে খাস্তা এবং পরিষ্কার ধরণের, এবং এই গ্লাসটি একজন মুমিনের হৃদয়ের মত। এটি তার স্বচ্ছতার গুণে সত্যকে দেখে এবং, জলপাই তেলের মতো, এটি বিশ্বাসী হৃদয়ের উপাদান; এটি উদ্ভূত বিস্ময়কর সেই দৈববাণীর “বৃক্ষ” থেকে (যা আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল তাঁর কিতাবগুলোতে প্রকাশ করেছেন)। [ইবনুল কাইয়িমের আল-ওয়াবিল আস-সায়্যিব] একজন বিশ্বাসী যত বেশী এই দৈববাণী মেনে চলে, তার অন্তরে ঈমানের শিকড় তত শক্তিশালী হয়!
আল্লাহর এই নামটি কে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
প্রথমত জানতে হবে সফলতা অর্জন করতে হলে আপনাকে কি অনুসরণ করতে হবে। আর নূর বলেছেন –
قَدۡ جَآءَکُمۡ مِّنَ اللّٰهِ نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। [৫:১৫]
এই নূর বলতে নবী মুহাম্মাদকে (ﷺ) বোঝানো হয়েছে। সাফল্যের প্রথম ধাপ হল কুরআন ও সুন্নাহকে সত্যিই আপনার পথপ্রদর্শক হিসাবে বিবেচনা করা এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করা যে শুধুমাত্র তারাই আপনার আন-নূরের আধ্যাত্মিক আলো পাওয়ার উপায়। তাদের মাধ্যমে আপনি জিনিসের বাস্তবতা দেখতে পাবেন এবং ভাল এবং খারাপের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য করতে শিখবেন।
আপনার দৈনন্দিন জীবনে কুরআন বোঝার প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর আলোতে আলোকিত হতে সচেষ্ট হন। প্রতিদিন অন্তত একটি আয়াত অর্থসহ পাঠ করুন এবং তা অনুশীলন করুন। কুরআনের মূল ভাষা বুঝতে শিখুন। যখন আপনি তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন তখন আন-নূর আপনার হৃদয়ে যে আলো দেন তা হল তাঁর প্রতি বিশ্বাস, জ্ঞান, ভালবাসা এবং তাঁর স্মরণ। আপনার দৈনন্দিন জীবনে কুরআন এবং সুন্নাহকে অগ্রাধিকার দিন যাতে আন-নূর আপনাকে পথপ্রদর্শন করেন এবং আধ্যাত্মিক স্বচ্ছতার সাথে আশীর্বাদ করেন।
আন-নূরের সন্তুষ্টির জন্য যত বেশি সম্ভব নেক আমল করুন যাতে পরকালে তিনি আপনার চেহারাকে আলোকোজ্জ্বল করেন।
وُجُوۡهٌ یَّوۡمَئِذٍ نَّاضِرَۃٌ সেদিন কোন কোন মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। [৭৫:২২]
اِلٰی رَبِّهَا نَاظِرَۃٌ তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে। [৭৫:২৩]
আপনার ইবাদত বৃদ্ধি করার একটি সুন্দর উপায় হল সারাদিন আপনার নিয়ত সম্পর্কে সচেতনভাবে চিন্তা করুন। যেকোনো কাজ যেমন ঘর গোছানো, রান্নাবান্না – এসব আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল’কে সন্তুষ্ট করার নিয়তে করুন, তাহলে তা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে।
শেষবিচার দিনের আলোর কথা ভাবুন। আপনার হৃদয় এই জীবনে প্রত্যাদেশের (কুরআন ও সুন্নাহ) আলোর প্রতি যত বেশি সাড়া দিবে, সেই ভয়ঙ্কর দিনে আপনার আলো ততই উজ্জ্বল হবে! তাই এই আমলগুলোকে পরকালের অন্ধকারে আলোর কারণ হিসেবে বিবেচনা করে নেক আমল বাড়াতে সচেষ্ট হন ইন শা আল্লাহ!
কৃতজ্ঞ হন। প্রতিদিন উপলব্ধি করুন যে আন-নূর আপনাকে অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোর দিকে পরিচালিত করেছেন এবং আপনার হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।
আন-নূরের কাছে প্রার্থনা করুন। আলো সম্পর্কিত কোরআনের এই দোয়াটি পড়ুন –
رَبَّنَآ أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَٱغْفِرْ لَنَآ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ মোটামুটি উচ্চারণ: রাব্বানা- আতমিম লানা- নুরানা- ওয়াগ ফিরলানা- ইন্নাকা আলা কুল্লি শায়ইন কাদির [৬৬:৮] অর্থ: ''আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য আমাদের রোশনি পরিপূর্ণ করুন, আর আমাদের পরিত্রাণ করুন। নিঃসন্দেহ আপনি সব-কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান।’’
আর মসজিদে যাওয়ার সময় এই সুন্দর দোয়াটি করুন –
“اللَّهُمَّ اجْعَلْ فِي قَلْبِي نُوراً، وَفِي لِسَانِي نُوراً، وَفِي سَمْعِي نُوراً، وَفِي بَصَرِي نُوراً، وَمِنْ فَوْقِي نُوراً، وَمِنْ تَحْتِي نُوراً، وَعَنْ يَمِينِي نُوراً، وَعَنْ شِمَالِي نُوراً، وَمِنْ أَمَامِي نُوراً، وَمِنْ خَلْفِي نُوراً، وَاجْعَلْ فِي نَفْسِي نُوراً، وَأَعْظِمْ لِي نُوراً، وَعَظِّمْ لِي نُوراً، وَاجْعَلْ لِي نُوراً، وَاجْعَلْنِي نُوراً، اللَّهُمَّ أَعْطِنِي نُوراً، وَاجْعَلْ فِي عَصَبِي نُوراً، وَفِي لَحْمِي نُوراً، وَفِي دَمِي نُوراً، وَفِي شَعْرِي نُوراً، وَفِي بَشَرِي نُوراً،
হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে নূর (বা আলো) দান করুন, আমার যবানে নূর দান করুন, আমার শ্রবণশক্তিতে নূর দান করুন, আমার দর্শনশক্তিতে নূর দান করুন, আমার উপরে নূর দান করুন, আমার নীচে নূর দান করুন, আমার ডানে নূর দান করুন, আমার বামে নূর দান করুন, আমার সামনে নূর দান করুন, আমার পেছনে নূর দান করুন, আমার আত্মায় নূর দান করুন, আমার জন্য নূরকে বড় করে দিন, আমার জন্য নূর বাড়িয়ে দিন, আমার জন্য নূর নির্ধারণ করুন, আমাকে আলোকময় করুন। হে আল্লাহ! আমাকে নূর দান করুন, আমার পেশীতে নূর প্রদান করুন, আমার গোশ্তে নূর দান করুন, আমার রক্তে নূর দান করুন, আমার চুলে নূর দান করুন ও আমার চামড়ায় নূর দান করুন।
[সহি বুখারী]
হে আল্লাহ, আন-নূর, আমরা জানি যে আপনি আলো (নূর) এবং সব ধরনের আলো আপনার কাছ থেকেই আসে। আপনার প্রত্যাদেশ অনুসরণ করার জন্য আমাদের পথনির্দেশনা দান করুন, যাতে এটি আমাদের জন্য এই জীবনে এবং পরবর্তী জীবনে আলোর উৎস হতে পারে।
আমাদেরকে বেশী বেশী নেক আমল করার তৌফিক দান করুন যাতে আমাদের মুখমন্ডল পরকালে আলোয় উজ্জ্বল হয়, আমাদের জন্য পুলসীরাতের আলো ফুটে ওঠে যাতে আমরা জান্নাতে আপনার আলোর সাক্ষী হতে পারি, আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
আন-নূর
Source: understandQuran