আল্লাহ রিজিক দাতা হলে মানুষ না খেয়ে মরে কেন
“পৃথিবীতে চলমান সকল প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি তাদের অবস্থানস্থল ও সংরক্ষণস্থল জানেন। সব কিছুই এক স্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে।” [সূরা হুদ ;৬]
সচরাচর নাস্তিকরা এই একটি আয়াত দেখিয়ে নানান রকম সমস্যা ও জটিলতায় ফেলে দেই। আমরাও অনেকে এতে বিচলিত হয়ে পড়ি। অনেকে আবার এই আয়াত দ্বারা বুঝে থাকেন রিজিকের দায়িত্ব যেহেতু আল্লাহর হাতে, তাহলে কেউ না খেয়ে থাকার কথা না। একদিকে কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় করছে আবার কিছু মানুষ না খেয়ে মরছে বা অভাব অনটনে কাটছে তাদের জীবন। কেন আল্লাহর সমঝোতা এমন কেন?
Allah makes some rich and some poor. Giving endless wealth to someone, and giving life to no one. How is his compromise? Did his promise come true?
এমন অভিযোগ রীতিমতো ভাইরাসের মতো ছড়াচ্ছে। অন্তত সন্দেহের বীজ বপন করছি মনে মনে।
আল্লাহ সকল প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব নিয়েছেন কথা সত্য কিন্তু কোন মানুষ না খেয়ে থাকা মানে আল্লাহ ওয়াদা রাখেনি এমনটা ঠিক নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের কিছু নিয়মের মধ্যে থাকতে বলেছেন। আল্লাহ আমাদের সবার রিজিকের মালিক এবং তিনি কিছু সিস্টেম তৈরি করেছেন যা মানুষের রিজিকের অভাব দূর করবে।
যেমন ধরুন সুরা যারিয়াত ৫১:১৯ = ধনীদের ধন সম্পদে রয়েছে অভাব গ্রস্থ ও বঞ্চিতদের অধিকার। এই আয়াত থেকে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে আল্লাহ চান যে তিনি যেই রিজিক ধনীদের দান করেছেন এখানে গরিবদের রিজিকও আছে সুতরাং ধনীদের সম্পদে যেই গরীবদের রিজিক আল্লাহ রেখেছেন সেই রিজিক ধনীরা যেন গরিবদের দান করে, মূলত এটাই হল আল্লাহর সিস্টেম, এটাই আল্লাহর আদেশ।
এই বিষয়ে আলোচনা করার আগে কিছু বিষয় আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা উচিৎ মনে করছি। চলুন একটু ঘুরে আসা যাক।
হলিউডের তুমুল জনপ্রিয় সুন্দরী মডেল ও অভিনেত্রী “কিম কারদেশিয়ানের” সঙ্গে একটু সময় কাটাতে ৪০ কোটি টাকা ঢেলে দিতে একটুও কার্পণ্য বোধ করেনি রিচার্ড লাগনার। প্রতি সন্ধায় একজন সেলেব্রেটির সাথে একটু নাস্তা করা, নাচ গান না করলে তার চলেই না।
রাশিয়ান ব্যবসায়ী সহস্র কোটিপতি “রোমান আব্রাহিমোভিচ” রেস্টুরেন্টে খেতে ৪০ লাখ টাকা খরচ করলেন একাই। “ম্যানহাটনের” এক রেস্টুরেন্টে অল্প কিছুক্ষণের জন্য বসেছিলেন, উদ্দেশ্য সামান্য নাস্তা করা। তিনি এমন ভাবে খাবারের অর্ডার করছিল যেন বেয়ারাদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। খাবারের বিল আসছে ৪০ লাখ টাকা। এনার মাত্র এক বেলার খাবারেই ৪০ লাখ !
দুবাইয়ের শেখ “হামাদ বিন হামদান আল নাইয়ান“, প্রায় ১২৫ কোটি টাকা খরচ করে দ্বীপজুড়ে খোদাই করেছেন নিজের নাম “হামাদ”। তার নাম এত সুবিশাল যে সেটি চাঁদ থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়। দ্বীপজুড়ে এ নামের দীর্ঘ ২ মাইল পর্যন্ত।
ভারতীয় ধনকুবের “লাক্ষি মিত্তাল” তার মেয়ের বিয়েতে ৫০০ কোটি টাকা খচর করে বিয়ে দেন। এই বিয়েতে সোনালী রং বাছাই করার কারনে পুরো প্রাসাদ ও আসবাব মুড়ে দেয়া হয় সোনালী রঙে , ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার করা হয় খাটি স্বর্ণ ।
[বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ নভেম্বর ২০১৯]
এবার একটু চিন্তা করুন তারা কি পরিমাণে সম্পদ অপচয় করছেন। তারা যা অপচয় করছেন, সেখানে কি আপনার আর আমার হক নাই?
এই সম্পদ গুলো অপচয় না করে যদি সুষ্ঠু ব্যবহারে গরীবের মাঝে বন্টন করা হতো, তাহলে কত মানুষের অভাব দূর হয়ে যেতো?
FAO-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গোটা পৃথিবীতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য আছে। কিন্তু তারপরেও কেন মানুষ অনাহারে থাকে? এর প্রধান কারন হল দারিদ্রতা।
[ world ]
এছাড়া FAO-এর আরও একটা রিপোর্ট বলে, প্রতিবছর গড়ে আমাদের খাবারের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়, যা প্রায় ১.৩ বিলিয়ন টনের সমান। এই ক্ষতির পরিমাণ উন্নত দেশে ৬৮০ বিলিয়ন এবং ৩১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।
[Source]
তাছাড়া একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১৮০০ কিলোক্যালরি যথেষ্ট, সেখানে আমেরিকাতে এর পরিমাণ মাথাপিছু ৩৭৫০!
[Source]
ভাবতে পারেন কিছু লোক না খেয়ে থাকছে, আর কিছু লোক খাবার অপচয় করে, ইচ্ছা মত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আবার স্রষ্টাকে দোষারোপ করে!
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আট জন ব্যক্তির হাতে যতো সম্পদ আছে সেই সম্পদের পরিমাণ দুনিয়ার অর্ধেক মানুষের সম্পদের সমান, বলছে আন্তর্জাতিক এক দাতব্য সংস্থা অক্সফ্যাম। সংস্থাটি এসংক্রান্ত যেসব তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশই বাড়ছে। এবং এই ব্যবধান যতো হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিলো আসলে তার চাইতেও অনেক বেশি। সবচে ধনী এই আট জনের মধ্যে রয়েছেন বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ এবং ওয়ারেন বাফেট। অক্সফ্যাম বলছে, এই আট জনের হাতে যতো সম্পদ রয়েছে তার পরিমাণ বিশ্বের ৩৬০ কোটি দরিদ্র মানুষের সম্পদের সমান।
তবে অনেকেই অক্সফ্যামের এই তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, প্রতি বছর অক্সফ্যাম সম্পদের যে পরিসংখ্যান তুলে ধরছে সেটা ঠিক আছে, কিন্তু সংস্থাটি এর যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেটি ঠিক নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অফ ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের একজন গবেষক মার্ক লিটলউড বলেছেন, অক্সফ্যামের উচিত প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর উপায়ের দিকে জোর দেওয়া। অক্সফ্যামের প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে প্রকাশ করা হলো যখন সুইজারল্যান্ডে শুরু হয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলন। এই সম্মেলনে বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা অংশ নিচ্ছেন। অক্সফ্যামের একজন কর্মকর্তা ক্যাটি রাইট বলেছেন, এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে ডাভোস সম্মেলন শুধু ধনী লোকেদের কথার ফুলঝুরির সম্মেলন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[BBC News বাংলা, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭]
পুরো পৃথিবীর মানুষ চলার মতো সম্পদ তো আল্লাহ এই দুনিয়ায় দিয়েছেন। সম্পদশালীরা যদি সম্পদের ভাগ গরীবের মাঝে বন্টন না করেন, তাহলে কি সেটা আল্লাহর দোষ?
“ইসলাম সম্পদকে অপচয় করাকে নিষেধ করে এবং গরীবদের দান করতে উৎসাহ প্রদান করে।”
[সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ৫৯৭৫, সহিহ হাদিস ।সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ৬৪৭৩, সহিহ হাদিস ।সুনানে আবু দাউদ, হাদিসঃ ২৮৭২, হাসান সহিহ ।জামে আত তিরমিজি, হাদিসঃ ৬৭২, সহিহ হাদিস।]
রাসুল (সা) আম্মাজান আয়েশা (রা) কে উপদেশ দিচ্ছেন যে, হে আয়শা! তুমি যঞ্জাকারী দরিদ্রকে ফিরিয়ে দিও না। যদি দেয়ার মত কিছু তোমার না থাকে, তাহলে একটি খেজুরের টুকরা হলেও তাকে দিও। হে আয়েশা! তুমি দরিদ্রদের ভালবাসবে এবং তাদেরকে তোমার সান্নিধ্যে রাখবে । তাহলে কিয়াময়ের দিন আল্লাহ তোমাকে তার সান্নিধ্যে রাখবে।
[জামে আত তিরমিজি, হাদিসঃ ২৩৫২ , সহিহ হাদিস]
সুষ্ঠু ভাবে যদি যাকাত আদায় করা হয়, তাহলে মূহুর্তের মধ্যে পুরো পৃথিবী সচ্ছল হয়ে পড়বে। থাকবে না কোন গরীব, থাকা লাগবে না কারও অনাহারে। আল্লাহর বলে দেওয়া সিষ্টেম বাস্তবায়ন না করে যদি তাঁর উপর অভিযোগ করি, বিষয়টা কেমন হয়ে দাঁড়ায়।