প্রায় প্রত্যেক লেখকের লেখালেখির শুরুটা হয় সাধারণত দুইভাবে। কারো শুরু হয় ‘By Chance’, কারো শুরু হয় ‘By Choice’। বাই চান্স লেখক হওয়াটা সমস্যার না, কিন্তু বাই চান্সকে ক্যারিয়ার বানানো সমস্যা। মনে করুন, একজন লেখকের প্রথম বই ১০,০০০ কপি বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশের পাঠক বিবেচনায় বইটি বেস্ট-সেলারের মর্যাদা পায়।
প্রথম বইয়ে আশাতীত সাড়া পেয়ে কেউ যদি মনে করে যে, সে লেখালেখিকে তার পেশা হিশেবে নেবে, এটা তার জীবনের অন্যতম একটি ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে। কারণ, রয়্যালটি সব বইয়ে সমান আসবে না। এক বই লেখার মতো পর্যাপ্ত রসদ হয়তো তার ছিলো, কিন্তু সারাজীবন বই বেঁচে উপার্জন করতে চাইলে তার যে কমপক্ষে ৫০ টি বই লিখতে হবে, সেই সামর্থ্য কি তার আছে?
এই প্রশ্নটি একান্ত নিজেকে করতে হবে।
‘Passion’ –কে ‘Profession’ হিশেবে নিতে গেলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করতে হয়, বর্তমানকে যাচাই-বাছাই করতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- পারিবারিক অবস্থা। ধরুন, যার মা-বাবা অসুস্থ, তাদের চিকিৎসার পেছনে মাসিক ৩০-৪০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। সেই ছেলেটি কিভাবে তার শখকে গুরুত্ব দিবে? সে কিভাবে এতো চাপ নিয়ে একটি ক্রিয়েটিভ কাজের ঝুঁকি নেবে?
ক্রিয়েটিভ কাজ করতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা দরকার, সেটা হলো- প্রেসার ফ্রি এনভারনমেন্ট। চাপের মধ্যে প্রফেশন সংক্রান্ত ক্রিয়েটিভ কাজ করাটা অনেকক্ষেত্রে অসম্ভব বটে। আমার জানামতে, নজরুল ছাড়া আর কোনো প্রফেশনাল রাইটার এমনটা পারেননি। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন ফুল-টাইম লেখক, লেখালেখিই ছিলো যার জীবিকা অর্জনের মাধ্যম। নজরুলের প্রায় বেশিরভাগ বিখ্যাত গান/কবিতা ছিলো ফরমায়েশী।
কারার ঐ লৌহ কপাট, উমর-খালিদ, রমজানের ঐ রোজার শেষে সহ বেশিরভাগ বিখ্যাত কবিতা ছিলো কারো অনুরোধে।
একটা সময় পর্যন্ত লেখালেখির জগতে আমার আগমন ছিলো বাই চান্স এবং শখ থেকে। কয়েকবছর পূর্বে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিই। ‘By Choice’ এবং ‘Profession’ হিশেবে লেখালেখিকে নেয়া। এটা হুটহাট এবং রাতারাতি চিন্তার ফল ছিলো না। চিন্তাকে আমার যুক্তি-আবেগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করেছি। কখনো সন্তুষ্ট হয়েছি, কখনো হইনি।
নিজের সাথে আমাকে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। আমার মতের বিরুদ্ধে আমি কোনো কিছু করতে পারি না। পারি না মানে পারিই না। যদি কিছু করি, সেরাটা উজাড় করে দেবো। যদি কিছু করবো না বলে ঠিক করি, মোটামুটি কাজ চালিয়ে যাবো না। ঐটা চিন্তা থেকেই বাদ দিয়ে দেবো।
নীলক্ষেত থেকে বিসিএসের বই কিনেছিলাম, IELTS –এর বইও কিনেছিলাম। আমি যে পরিবেশে বড়ো হয়েছি, সেই পরিবেশে সাফল্যের মাপকাঠি হলো- লন্ডন-অ্যামেরিকায় গিয়ে স্যাটেল হওয়া। আমি যদি আমার জীবনের লক্ষ্য হিশেবে ঐ দুটোর একটিকে ক্যারিয়ার গোল হিশেবে নিতাম, আমার বিশ্বাস ছিলো, আমি ব্যর্থ হতাম না ইন শা আল্লাহ।
আজকের বিকেলটা হয়তো আমি লন্ডনের টেমস নদীর পাশে বসে কাটাতাম কিংবা নিউইওর্কের ব্যস্ত রাস্তায়।
কিন্তু, আমি আমার স্বপ্নের কাছে হার মানতে রাজি ছিলাম না। বারবার আমার কাছে মনে হতো, আমাকে সৃষ্টির পেছনে, আমার এই ভূখণ্ডে জন্মানোর পেছনে নিশ্চয়ই আল্লাহর প্ল্যান আছে। এটা তাকদীরের কাছে পরাজয় বরণ নয়, এটা হলো তাকদীরকে উপলব্ধি করা। কারণ, আমি লন্ডন-অ্যামেরিকায় যাওয়া মানে একটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে সাত সাগর পাড়ি দেয়া। সেই উদ্দেশ্যের সাথে আমার স্বপ্ন ‘প্রাইমারি’ হিশেবে জড়িয়ে নেই; থাকলে হয়তো ‘অপশনাল’ হিশেবে আছে।
আমি যে জনরার বই সবচেয়ে বেশি পড়েছি, সেটা হলো- জীবনী এবং আত্ম-জীবনী। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পড়ে আমি জীবন সম্পর্কে কিছু বাস্তব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা নেবার চেষ্টা করেছি। তবে, সেটা কপি-পেস্ট ফর্মুলা না। আরেকজনের জীবনে কোনো সমস্যার সমাধান আমার জীবনেও যে একই হবে, এমনটা তো আমি ভাবি না।
আমি একটা বিষয় বুঝতে পারতাম যে, কোনো ভাষায়, কোনো বিষয়ে লিখতে গেলে সেই ভাষার পাঠক এবং সেই ভাষার উপাদান চোখের সামনে থাকতে হয়। এটা সাময়িক লেখালেখির জন্য না, ক্যারিয়ার হিশেবে সারাজীবনের লেখালেখির জন্য। একজন লেখক যে ভাষায় লিখছেন, সেই ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ডিস-কানেক্ট হয়ে সারাজীবন লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারেন না।
লন্ডন-অ্যামেরিকায় বসে কেউ হয়তো মাঝেমধ্যে লম্বা-লম্বা পোস্ট লিখেন, কিন্তু ক্যারিয়ারিস্ট রাইটার কি পারবেন বাংলার মাটি, বাংলার জল না দেখে বাংলা উপন্যাস নিউইওর্কের লেখার টেবিলে বসে লিখতে? হয়তোবা কেউ পারবেন, হয়তোবা পারবেন না।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুজন লেখক হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদ। দুজনই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বছর অ্যামেরিকায় কাটান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্ম-জীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে দেখলাম, অ্যামেরিকার বিলাসী পরিবেশ ছেড়ে ধুলোমাখা বাংলার জমিনে এসে স্থায়ী নিবাস গড়েন। তার অন্যতম কারণ ছিলো, সেখানে বসে তিনি বাংলায় কিছু লিখতে পারছিলেন না।
হুমায়ূন আহমেদ পিএচডি করার জন্য অ্যামেরিকায় যাবার আগে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিলো ৬ টি। তাঁর আত্ম-জীবনীতে পড়েছিলাম, অ্যামেরিকায় গিয়ে তিনিও সাবলীলভাবে লিখতে পারেননি, ফিরে আসেন বাংলাদেশে।
‘বিদেশে গিয়েও লিখবো’ এই চিন্তা যখন মাথায় এসেছিলো, তখন এমন দুটো উদাহরণ পড়ে আমি আসলে সাহস করতে পারিনি। এমনটা আমারও কনসার্নে ছিলো। জীবনের সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যখন আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিই- লেখালেখির সাথে আমি ঘর সংসার বাঁধবো, তখন আরেকটি কাজ করি। আমার চিন্তাকে মজবুত করার জন্য একটি খুঁটির দরকার ছিলো। আজ বলছি লন্ডন-অ্যামেরিকায় যাবো না, কাল হয়তো কোনো লন্ডনী-অ্যামেরিকানী মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি জমাবো!
এমন ভাবনার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। কারণ, আংকেল-আন্টি শ্রেণীর কাছে আমি ছিলাম বিশেষ প্রিয় (এমনকি বর্তমানে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কাছেও)! কখনো আমার গুণমুগ্ধ বিদেশী কোনো আংকেল-আন্টি যদি পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান, এমন লোভনীয় প্রস্তাব কেউ ফেলে দিতে পারতো না। আমি কিছু গুঞ্জনও শুনছিলাম। আমার স্বপ্নের কাছে লোভ পরাজিত হবে?
আমার ক্যারিয়ার গঠনেরও আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিই। আমার স্বপ্ন পূরণের অন্যতম মজবুত খুঁটি হবে- বিয়ে করা। তা-ও এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিশেবে পাওয়া, যে আমার স্বপ্নকেও ধারণ করতে পারে, লালন করতে পারে। বিয়ের মাধ্যমে লেখালেখিকে ‘By Choice’ এবং ‘Profession’ হিশেবে নেবার ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছি।
এটা মোটেও আবেগী সিদ্ধান্ত ছিলো না। ব্যবসায়ের শিক্ষার্থী হিশেবে আমি পর্যাপ্ত SWOT Analysis করেছিলাম। আমার দীর্ঘজীবনে কী ধরণের বাধা-বিপত্তি এমনকি অভাব-অনটন আসতে পারে, সেটা সম্পর্কে পূর্ঙাঙ্গ ধারণা রেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিই। আমার লাইফ আর দশজনের মতো হবে না, আমার লাইফস্টাইলের তুলনা আর দশজনের মতো হবে না এটা জেনে, পরিবারকে জানিয়েই তবেই এ পথে হাঁটা শুরু করি।
দুই
আমি কী নিয়ে লিখেছি এবং কী নিয়ে লিখবো, এই সংক্রান্ত পরিষ্কার ধারণা নিয়েই আমি আমার লেখালেখির ভুবন সাজিয়েছি। লেখালেখির মূল কাঁচামাল হলো পড়াশোনা। পড়াশোনার ব্যাপারে আমি কখনো কম্প্রোমাইজ করবো না। ফেসবুকে একসময় অনেক লেখকের লেখা আমি মন দিয়ে পড়তাম।
এখন তাদের লেখা পড়ে সেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। কারণ, তারা পড়াশোনা অনেকটা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আগের মতো পড়াশোনা করতে পারেন না। এমন লেখকদের নাম উল্লেখ করছি না, এই লেখাটি যারা পড়ছেন তারা প্রায় সবাই তাঁদেরকে চিনেন।
আমার লেখালেখির নীতি হলো, কোনো বিষয় সম্পর্কে শতোভাগ নিশ্চিত না হয়ে সেই বিষয়ে আমি টাইপিং শুরু করি না। আমি সমসাময়িক ঘটনাগুলো নিয়ে কম লিখি। কারণ, সমসাময়িক বিষয়গুলোতে লেখার মতো পর্যাপ্ত পড়াশোনা আমার নেই। কিন্তু, আমি যা নিয়ে লিখতে বসি, সে সম্পর্কে আগে নিজে কনভিন্সড হয়ে নিই। আমি যা লিখি, হতে পারে সেটা একটি মত; এটার আরো মত আছে।
আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের লেখালেখির কন্টেন্ট আমি নিজেই নির্বাচন করি। সাধারণত, প্রকাশনীর এসাইনমেন্ট অনুসারে লিখতে মন সায় দেয় না। আরেকজনের চিন্তার বোতলে আবদ্ধ হয়ে লিখতে পারবো না বলে অনুবাদ করি না; যদিও অনুবাদ করলে এককালীন অনেক নগদ টাকা আসে।
আমি সারাজীবন কী লিখবো সেটা সম্পর্কে পাঠককে ডিসক্লেইমার দেয়াটা জরুরি মনে করি। কারণ, আমি চমক সৃষ্টি করার জন্য এই ফিল্ডে আসিনি। আমি স্বেচ্ছায়, ক্যারিয়ারের ঝুঁকি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসিনি পাঠকের শুধুমাত্র বাহবা পাবার জন্য। তাই বলে, পাঠকের স্বীকৃতি আমি চাই না, এমন না। কিন্তু, পাঠকের স্বীকৃতি আমার মূল কনসার্ন না। কেনো, সেটা ব্যাখ্যা করবো।
আমার লেখালেখিকে আমি তিনভাগে ভাগ করেছি। এই তিনভাগেই আমি লেখালেখি করবো, ইন শা আল্লাহ।
১। আমার শতকরা ৮০% লেখালেখি হবে সাধারণ কথা অসাধারণভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা। এই বিষয়গুলো নিয়ে পাঠকের মৌলিক কোনো দ্বিমত থাকবে না (ছোটোখাটো কারেকশন হতে পারে)।
যেমন: এক মলাটে ৩২ জন সাহাবীর জীবনের গল্পগুলো তুলে ধরা, সাহাবীদেরকে টাইটেল দ্বারা চিহ্নিত করে লিখা ‘তারা ঝলমল’ বই। বইটির কন্টেন্ট সাধারণ, সবাই জানে এসব; আমি শুধু বর্তমান সময়ের পাঠকের ভাষায় লিখেছি। ‘প্রদীপ্ত কুটির’ –এ সুন্নাহর অনুসরসণ দেখিয়েছি মাহির-লাফিজার মতো ইয়াং কাপলের মাধ্যমে। ‘চার তারা’ বইয়ে চার ইমামের রঙিন জীবন রংতুলিতে আঁকার চেষ্টা করেছি।
এই সবগুলোই হলো ঐ আশি পার্সেন্টের অন্তর্ভুক্ত; যা সাধারণ পাঠকের জন্য লিখেছি। ভবিষ্যতে লিখবো- ‘শিক্ষা সফর’, ‘সিরাজাম মুনীর’, ‘খোপার বাঁধন’, ‘মন ঘুড়ি’, ‘পুণ্যবতী’, ‘ইসলামের সৌন্দর্য’ ইত্যাদি। এসব লেখাগুলো হবে পপুলিজমকে কেন্দ্র করে, তাদের উপযোগী করে।
২। আমার ১০ পার্সেন্ট লেখালেখি হবে মানুষকে নতুন করে চিন্তা করানোর জন্য। সহজ কথায়- পপুলিস্ট কোনো ন্যারেটিভ ভাঙ্গার জন্য এই ধরণের লেখালেখি করবো। এই ধরণের লেখায় দলীল এবং যুক্তি উপস্থাপন করে পাঠককে চিন্তা করার জন্য রাস্তা খুলে দেবো। সে প্রথমে মানতে রাজি না হলেও স্বল্পসময়ের মধ্যে মেনে নিবে। এক্ষেত্রে পাঠকের নীতি হবে- ‘সত্য: শুনলাম এবং মেনে নিলাম’।
এই ক্যাটাগরির দুটো লেখার উদাহরণ দিই। একটি হলো ‘এপ্রিল ফুল মিথ’, আরেকটি হলো ‘নজরুল পাঠ’। পহেলা এপ্রিল নিয়ে মুসলিম মানসে একধরণের মিথ প্রচলিত যে, এই দিন আন্দালুসে মসজিদে ঢুকিয়ে মুসলিমকে ফুল (Fool) বানানো হয়েছিলো। এটা ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা। এই টপিক নিয়ে বছরখানেক আগে লিখেছিলাম, কয়েকশো মানুষ জানিয়েছেন যে, তাদের ভুল ভেঙ্গেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক কবি, যাকে কেউ-ই সম্পূর্ণভাবে ধারণ করতে পারবে না। সে হোক হিন্দু, মুসলিম, কমিউনিস্ট, নারীবাদী, মানবতাবাদী। কারণ, নজরুল কোনো নির্দিষ্ট একটি মতবাদে স্থির থাকতে পারতেন না। সেই নজরুল বাংলা সাহিত্যকে ইসলামিকরণ করেন, সাহিত্যে ইসলামকে জনপ্রিয় করেন।
তাঁর পূর্বেও অনেকে বাংলা সাহিত্যে ইসলাম নিয়ে লিখছেন, কিন্তু নজরুল পথের সূচনা করেন; সেই পথে দাঁড়িয়ে ‘লা-শরীক আল্লাহ’ যেভাবে বলেছেন, বিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের যে ভাষা দিয়েছেন, সেই লিগ্যাসী আজ আমরা বহন করছি।
ইসলামকে ভালোবাসেন, এমন অনেক বাঙ্গালী ছিলেন-আছেন। কিন্তু, বাংলা সাহিত্যে বলিষ্ঠকণ্ঠে আজতক নজরুলের মতো মৌলিক সাহিত্য রচনা কেউ করেননি। এক নজরুল সাহিত্যের গথিপথ পাল্টে দিয়েছেন। মুসলমান সংস্কৃতি নিয়েও যে কবিতা লিখা যায়, সেই কবিতাও যে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বাংলা সাহিত্যে নজরুল সেটা করে দেখান।
নজরুলের এই ঋণ আমি ভুলতে পারবো না। কারণ, বাংলা সাহিত্যে আমার মুখের ভাষা নজরুলই প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। সেই নজরুলকে যেমন কেউ পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না, তেমনি ইসলামপন্থীরাও পারবে না; আমি নিজেও পারবো না। অন্যরা কী করেছেন, নজরুলকে যতোটুকু প্রয়োজন, ততোটুকু নিয়েছেন।
কিন্তু, হাল-আমলের ইসলামপন্থীরা নজরুলকে নেয়া তো দূরের কথা, নজরুলকে খারিজ করেই দিয়েছে! তারা ‘ত্রি-ভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’, ‘আমি যদি আরব হতাম’ গাইতে দিচ্ছেন না।
এই জায়গায় এসে দেখি সবাই বাকরুদ্ধ। কোনো বয়ান হাজির করতে পারছে না। কেউ কেউ অতি-আবেগী হয়ে নজরুলকে ইসলামিস্ট বানাতে চাচ্ছে, কেউ কেউ তাকে কাফির-মুরতাদ বানাতে চাচ্ছে।
আমি আমার বয়ান হাজির করলাম খুব ভিন্নভাবে। নজরুল যদি কাফির কবি হতেন, তবুও কি নজরুল পরিত্যাজ্য? রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সীরাত এবং সাহাবীদের জীবনী থেকে আমি প্রমাণ করলাম- তাঁরা কাফির কবিদের ভালো-ভালো কবিতা, যেগুলোতে শিরক ছিলো না, সেগুলোর চর্চা করতেন, প্রশংসা করতেন।
সেখানে নজরুল যদি কাফির কবিও হোন, তাকে কোন যুক্তিতে ফেলে দেবো? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো উমাইয়্যা ইবনে আবিস সালাতকে ফেলে দেননি!
নজরুল সংক্রান্ত আমার লেখাগুলো ছিল এই ধারার। এই লেখাগুলো দলীল এবং যুক্তিনির্ভর; যা পাঠককে নতুনভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে।
৩। আমার ১০ পার্সেন্ট লেখালেখি হবে ভবিষ্যতের জন্য। বয়স যতো বাড়বে, যতো বেশি পরিপক্বতা আসবে, এই ধরণের লেখালেখি ততো বাড়বে। এই টাইপের লেখালেখি বর্তমান সময়ের ৯০ পার্সেন্ট মানুষ ছুঁড়ে ফেলবে, সমালোচনা করবে, জেল-যুলুম-নির্যাতন হতে পারে জেনেই লিখেছি-লিখবো।
কারণ, এই ক্যাটাগরির লেখাগুলোর মাধ্যমে নতুন কোনো বয়ান হাজির করবো; যা মানুষ আগে কখনো শুনেনি। আর যা মানুষ আগে কখনো শুনেনি, যা প্রচলিত চিন্তার বিরুদ্ধে, তা সামান্য শুনেই মানুষ প্রত্যাখ্যান করে।
আমি ধরেই নিয়েছি, এই ধরণের লেখাগুলোর পাঠক আজকের না। তারা আগামী ২০-৫০ বছর পর এই লেখাগুলো বিশ্লেষণ করবে, আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনা করবে। আমার বাকি ৯০ ভাগ লেখাগুলো আমার মৃত্যুর ২০-২৫ বছর পর হয়তো আবেদন হারিয়ে ফেলবে; কারণ, ঐসব লেখাগুলো আমি বর্তমানের জন্য লিখবো। কিন্তু, তৃতীয় ক্যাটাগরির ১০ ভাগ লেখাগুলো পাঠক না পারবে গিলতে, না পারবে ফেলে দিতে।
এই ধরণের লেখালেখির একটি উদাহরণ হলো ‘ইতিহাসের আলোকে ক্ষমতা তত্ত্ব’। এই ধারার একটি টপিকে লিখতে গিয়ে আমি যদি ৫,০০০ পৃষ্ঠা পড়ি, বিশ্লেষণ করি, চিন্তা করি; তাবেই লিখি মাত্র ১০ পৃষ্ঠা। যা লিখি, তা যে কনফিউশন থেকে লিখি, এমন না। প্রাথমিক চিন্তাই লিপিবদ্ধ করে প্রচার করি, এমনও না। এই চিন্তাগুলো বিজ্ঞজনকে দেখাই। তাদের স্তব্দতা, নির্ভাক মুখায়ব আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
গতোকাল রাতে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার (রাহিমাহুল্লাহ) জীবনী পড়ছিলাম। তাঁর জীবনের মতো মুগ্ধকর জীবনী আমি আর পড়িনি (এক্সেপ্ট: নবিজী)। তিনি বিয়ে করেননি, কিন্তু ৫ মাস ১৮ দিন কারারুদ্ধ থাকেন তালাকের ফতোয়া দিয়ে!
চার মাজহাবের ইমাম তিন তালাক এবং হলফ বি’ত তালাক নিয়ে যে ফতোয়া দিয়েছিলেন, তাঁরটা ছিলো একেবারে বিপরীত। একেবারে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ইবনে তাইমিয়া হাদীসের দলীল এবং যুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় হাজির করেছিলেন। তাঁর যুগের আলেমগণ তাঁকে ফতোয়া দেয়া থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন, চাপ প্রয়োগ করেন, শাসক এতে হস্তক্ষেপ করে তাঁকে কারারুদ্ধ করে।
প্রায় ৭০০ বছর আগে যে ফতোয়ার জন্য ইবনে তাইমিয়া কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, ৭০০ বছর পর সেইসব ফতোয়াগুলো নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস লিখা হচ্ছে। কেউ ইবনে তাইমিয়ার মতের পক্ষে থিসিসের কনক্লুশন টানছেন, কেউবা মাজহাব চতুষ্টয়ের ইমামগণের পক্ষে।
আমি আশঙ্কা করছি, আগামী ২০-৩০ বছর পর ইমাম ইবনে তাইমিয়ার তালাক সংক্রান্ত ফতোয়াটি আরো জনপ্রিয় হবে। বিবাহ ও বিচ্ছেদ যে হারে বাড়ছে, মানুষ হয়তো নতুন করে সেটাকে উপলব্ধি করে এই সংক্রান্ত নতুন কোনো কনক্লুশনে পৌঁছাতে পারে (এটা আশঙ্কার কথা বললাম)।
আমার যোগ্যতাকে আমি ইবনে তাইমিয়ার সাথে কম্পেয়ার করবো না। কারণ, আমি তাঁর ধারে-কাছে যাওয়া তো দূরে কথা, আমি তাঁকে পড়ার যোগ্যতাই রাখি না।
আমি যা বলবো, সেটার প্রতিক্রিয়া জেনেই বলবো। এমন না যে, আমার বলাটাই শেষ কথা। আমার এই ধরণের লেখালেখির শতো-শতো কাউন্টার আসবে জেনেই লিখবো।
যদি কোনো কাউন্টার আমার চিন্তার প্যারাডাইমকে চেইঞ্জ করে দিতে পারবে, আমি প্যারাডাইম শিফট করতে এক সেকেন্ডের জন্যও হীনমন্যতায় ভুগবো না। কারণ, আমার এই ধরণের লেখার উদ্দেশ্য আমার মত প্রতিষ্ঠা না, সত্যকে নতুন আঙ্গিকে উপলব্দি করার আলোচনা শুরু করা। এমন আলোচনায় অসংখ্য গালাগালি শুনবো, ট্যাগ পাবো, এমনকি ক্রসফায়ার, ফাঁসির মঞ্চেও যাওয়া লাগতে পারে।
সালমান আল-আওদাহ (হাফিজাহুল্লাহ) বলেন, “শহীদ হয়ে মৃত্যুবরণ করা সহজ। ‘শহীদ’ হয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন।”
আমি বিজয়ী হতে আসিনি, আমি সফল হতেও আসিনি। আমি এসেছি- আমি যা সত্য বলে ধারণ করি, তা বুক ফুলিয়ে বলতে; যতোক্ষণ না কেউ আমার ধারণ করা সত্যকে ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত করে। সত্য-সুখের আনন্দ মগজ বর্গা দিয়ে পাওয়া যায় না।