আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালাম কে সৃষ্টির পূর্বে জিনদের সৃষ্টি করেছিলেন। যেমন এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন,
وَالْجَآنَّ خَلَقْنَاهُ مِن قَبْلُ مِن نَّارِ السَّمُومِ
এর পূর্বে জিনদের সৃষ্টি করেছি আগুনের শিখা থেকে।
[সূরা হিজর :২৭]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা একদিন ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি পৃথিবীতে ‘খলীফা’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। বল, এ বিষয়ে তোমাদের স্পিচ কি? তারা (সৃষ্ট জিন জাতির তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আগে থেকেই জানতেন, কারন পৃথিবীতে যখন কিছুই কিছু না তখন শুধু জিন জাতিরাই ছিলো। তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লাকে ভুলে গিয়ে মারামারি, হানাহানি, রক্তপাতে লিপ্ত ছিলো )
বলল, হে আল্লাহ! আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে প্লানটিং করতে চান, যারা গিয়ে সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তারক্তি ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদা আপনার হুকুম পালনে এবং আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনায় রত আছি।
এখানে ফেরেশতাদের উক্ত বক্তব্য অবজেকশন এর জন্য ছিল না, বরং জানার জন্য ও বুঝার জন্য ছিল। কারণ আমার রবের কোন পরিকল্পনার এগেনেস্টে আপত্তি প্রেজেন্টেশন করার অধিকারই ফেরেশতাদের ছিলো না। তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না। [বাক্বারাহ ২/৩০]
অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা এ দুনিয়াতে এমন একটা সৃষ্টির উদঘাটন করতে চান , যারা হবে দ্যা বেস্ট ক্রিয়েচার অব ক্রিয়েশন (সৃষ্টির সেরা জীব)।
এ ভূপৃষ্ঠের যতগুলো মাটি আছে সব মাটি থেকে অল্প মাটি এক জায়গায় করে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালামকে সৃষ্টি করলেন। সপ্তাহের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো শুক্রবার। আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সৃষ্টি করেছেন শুক্রবারে এবং জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন শুক্রবারেই।
অতঃপর আমার রব আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালামকে প্রয়োজনীয় সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দিলেন। পরে তিনি সেগুলো ফেরেশতাদের কাছে সাবমিট করে বললেন, তোমরা যদি তোমাদের আশঙ্কার ব্যাপারে সত্যবাদী হও তাহলে তোমরা আমাকে নাম গুলো বলতো। ফেরেশতারা বলল, হে আল্লাহ! তুমি পবিত্র আমাদেরতো এর বাইরে আর কিছু জানা নেই তুমি আমাদের যা শিখিয়ে দিয়েছ তুমি একমাত্র জ্ঞানী, একমাত্র কৌশলী! এবার আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালামকে বললেন তুমি তাদের কাছে তাদের নামগুলো বলে দাও। অতঃপর আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালাম জিনিসপত্রের নাম গুলো বলে দিলো।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা ফেরেশতাদের বললেন তোমরা আদমকে সাজদা করে অতঃপর তারা আল্লাহর আদেশে সাজদা করল শুধু আযাযিল সাজদা করতে অস্বীকার করল। সে অহংকার করল।
তাইতো সে নাফরমানদের সঙ্গে শামিল হয়ে গেল। হয়ে গেল ইবলিশ শয়তান। সে আদম আলাইহহিস সালাতু ওয়াসাল্লামের এর প্রতি কি পরিমাণ জেলাস করেছে তা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উঠে এসেছে:
আমার রব বললেনঃ আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সেজদা করতে বারণ করল?
ইবলিস বললঃ আমি তার চেয়ে বেস্ট, তার চেয়ে গ্রেটেস্ট, তার চেয়েও আইডল, অবশ্যই আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ট। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা।
[সূরা আল-আরাফ:১২; সূরা সাদ: ৭৬]
আমার রব বললেনঃ হে ইবলিস, তোমার কি হলো যে তুমি সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত হতে স্বীকৃত হলে না?
ইবলিস বললঃ আমি এমন নই যে, একজন মানবকে সাজদা করব, যাকে আপনি পচা কর্দম থেকে তৈরী ঠনঠনে বিশুষ্ক মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।
[সূরা আল-হিজর: ৩২-৩৩]
অতপর আমার রব বললেন, তুই এখান থেকে যা। এখানে অহংকার করার কোন অধিকার তোর নাই। অতএব তুই বের হয়ে যা। তুই হীনতমদের অন্তর্ভুক্ত।[সূরা আল-আরাফ:১৩] বের হয়ে যা, এখান থেকে। কারণ, তুই অভিশপ্ত।[সূরা আল-হিজর:৩৪; সূরা সাদ:৭৭]
আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টির পর এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একাকী জীবনযাপন করতে থাকলেন। কিন্তু তিনি প্রচুর সুখ, শান্তিতে লাইফ লীড করার পরও এক ধরনের নির্জনতা, একাকীত্ব, সঙ্গীহীন ফিল করছিলেন। দেখা গেলো, তাঁর স্বভাব ও প্রকৃতি কোনো জীবনসঙ্গিনীর, প্রিয়তমার, অন্বেষণ করছেন। একা একা তো এভাবে আসলেই থাকা যায় না। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা হাওয়া আলইহিস সালামকে সৃষ্টি করলেন। কারন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লামের প্রয়োজন সম্পর্কে জানতেন। তিনিই তো এভাবে সৃষ্টি করেছেন তাঁর বান্দাকে। একমাত্র আমার রবই এসব প্রয়োজন থেকে মুক্ত।
হাওয়া আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লাম এর পাজরের হাঁড় দিয়ে। الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ‘যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।’ [সুরা নিসা:১]
এখানে হাওয়া আলাইহিসসালাম এর সৃষ্টির ব্যাপারে বলা হয়েছে- وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا ‘তার (আদম) থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন’।
আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লাম নিজের জীবনসঙ্গী পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করলেন। প্রিয়তমাকে পেয়ে তিনি এখন অনেকটা শান্ত, ধীর, স্হিরতা ও পরম ভালোবাসা ফিল করলেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার পক্ষ থেকে আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালাম এর প্রতি এই অনুমতি ছিলো যে জান্নাতের যেখানেই ইচ্ছা তাঁরা বসবাস করবেন, যে-কোনো বস্তু ইচ্ছা ব্যবহার করবেন, যা মন চায় খাবেন। কুরআনে এসেছে- وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا ‘হে আদম! তুমি এবং তোমার সঙ্গীনী জান্নাতে প্রবেশ করো। অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও।’ [সুরা আরাফ:১৯]
আমার রব আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালাসকে বললেন, হে আদম তুমি এবং তোমার স্ত্রী পরম সুখে জান্নাতে বসবাস করতে থাকো এবং এখান থেকে যা তোমাদের মন চায় তাই তোমরা সব তৃপ্তির সাথে আহার করো। এখানে তোমার জন্য কোন বাধা নিষেধ নেই। তবে তোমরা এ গাছটির নিকট যেও না। গাছটির কাছে গেলে তার পরিণতি কি হবে আমার রব তাও জানিয়ে দিলেন। বলে দেওয়া হলো এমনটি করলে তোমরা দুজনে সীমালংঘনকারীদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবে। মনে রেখো কিন্ত। মূলত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা পৃথিবীতে তাঁর খলীফা নিযুক্ত করে পাঠানোর আগে তাদের দু’জনকে পরীক্ষা করার জন্য জান্নাতে রেখেছিলেন। সাথে একটি নিষিদ্ধ গাছও।
ওদিকে ইবলিস শয়তান যে কোন কৌশলেই, যে কোন চক্রান্তেই আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালামকে জান্নাত থেকে বের করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলো। জান্নাতে পরম শান্তিতে বসবাসরত আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালামের সুখ-শান্তি দেখে তার জেলাস দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।
আযাযিল একসময় ঠিকই তাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার নির্দেশ ভুল যেতে বাধ্য করলো। যার ফলে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে সাথে সাথে তাদের দেহ থেকে জান্নাতের পোশাকগুলো খসে পড়ে গেল। তখন তারা লজ্জিত হয়ে গাছের পাতায় তাদের লজ্জাস্থানের আবৃত করল।
আমার রব বললেন, তোমাদেরকে পানিশমেন্ট হিসেবে জান্নাত থেকে বের করে দিচ্ছি। একজন আরেকজনের দুশমন হিসেবে এখান থেকে নেমে পড়ো তোমাদের পরবর্তী বাসস্থান হচ্ছে পৃথিবী সেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের জন্য জীবনের যাবতীয় উপকরণ থাকবে যাবে সেখানে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে অবশ্যই হেদায়েতের মেসেজ পাঠাবো। অতঃপর যে আমার হেদায়েত মেনে চলবে তাদের কোন ভয় নেই তাদের কোন প্রকার উৎকন্ঠিত হবে না। অতঃপর তাদেরকে পৃথক পৃথক স্থানে নামিয়ে দেওয়া হয়।
পৃথিবীর জায়গাটা ছিলো দুজনের জন্যই অপরিচিত, অচেনা, অজানা । তার মধ্যে দু’জন দু’দিকে। কতইনা কষ্টকর বিরহ।
অনুতাপের সাথে সাথে শুরু হলো তাদের বিরহ বেদনা। স্বামী জানেনা কোথায় তার প্রিয়তমা। স্ত্রীও জানেনা কোথায় তার প্রিয়তম জীবনসঙ্গী। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ বেদনা কাতরাচ্ছেন আদম, হাওয়া আলাইহিস সালাম। এ শূন্য পৃথিবীতে তারা নিজ নিজ অঞ্চলে একা একা ভীষণ করুণ অবস্থায় বসবাস করেছিলেন কিছুদিন।
ইতোপূর্বে তারা এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হননি তাই তারা চরমভাবে বিচলিত হয়ে মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি বাক্য আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াসসাল্লাম কে শিখিয়ে দিলেন। অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার শিখিয়ে দেওয়া বাক্যগুলো পাঠ করতে থাকলেন। অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাদের দোয়া কবুল করলেন। নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।
আদম, হাওয়া আলাইহিসসালাম ও আযাযিল