আগাছা থেকে বটগাছ
[১]
এইযে মা তোমার ছেলে ডাক্তার নিয়ে এসে গেছে। তোমাকে আর কষ্ট পেতে হবে না- বলে বিছানার দিকে তাকাতেই ছোটন দেখলো, তার মা চুপচাপ শুয়ে আছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। একটু আগেও তো মা কষ্টে চিৎকার করে ডাক্তার ডাকার কথা বলছিলো। কিন্তু ডাক্তার আসার পর মা এমন চুপ হয়ে গেল কেন!
এমন নিশ্চুপ পরিবেশ দেখে তার শরীর ভয়ে হিম হয়ে যাচ্ছিলো। অনেকটা সাহস যুগিয়ে ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে মায়ের বিছানার দিকে কাঁপা কাঁপা পায়ে সে এগিয়ে যায়। ডাক্তার সাহেব নাড়ি পরীক্ষা করে দেখেন, নাড়ির ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তা আর কখনো চলবে না। তিনি ইহকাল ত্যাগ করে পরকালের পথে পাড়ি জমিয়েছেন।
তোমার মা আর বেঁচে নেই, ছোটন। তিনি রবের প্রিয় হয়ে গিয়েছেন। কথাটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেছিলেন ডাক্তার সাহেব।
কথাটা শোনার পর ছোটন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লো। দুনিয়ার বুকে তার মা’ই যে তার একমাত্র ছায়া ছিল। একমাত্র মা’ই তাকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তার সব আবদার পূরণ করতো। তার মা এখন আর দুনিয়াতে নেই কথাটা ভাবতেই সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করলো সে। যতো তাড়াতাড়ি তাকে কবর দেয়া যায় ততো উত্তম। তার মা একদিন কথার ছলে তাকে বলেছিলেন, “বাবা আমি যখন মইরা যামু আমারে যেন কোন পরপুরুষে না দেখে। যত তাড়াতাড়ি পারবি আমারে কবর দিয়া দিবি।”
সেই কথাটিও রক্ষার চেষ্টা করেছে সে।
তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তাদের কিছু আত্মীয় স্বজনরা দেখতে আসে। দাফন কাফন শেষ করে সবার যার যার গন্তব্যের পানে চলে যায়। ছেলেটির কথা কারও মাথায়ই আসে নি। তার তো এখন দুনিয়ার বুকে কেউ নেই, সে কীভাবে থাকবে এই কথাটিও একবার ভেবে দেখার মতো সুযোগ হয়নি কারও।
[২]
পরদিন ছোটনের সাথে দেখা করতে আসেন তার চাচা আফজাল হোসেন। এসে দেখেন ঘরের এককোনায় গুটিসুটি হয়ে পড়ে আছে সে। হাতে তার মায়ের পরনের একটি শাড়ি। শাড়িটাতে হাত বুলচ্ছে আর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
দশ বছরের ছেলেটা কি এই শোক সামলাতে পারে!
কথাটা ভাবতেই আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলেন আফজাল সাহেব। “তাকে এভাবে একা ঘরে রেখে যাওয়া যাবে না। এতে করে ছেলেটা অসুস্থ হয়ে যাবে। তাকে বরং আমার সাথে করে নিয়ে চলি। পারুল কিছু বললে তাকে নাহয় আমি একটু কষ্ট করে রাজি করিয়ে নিবো” কথাগুলো বিড়বিড় করে বলছিলেন তিনি।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ছোটনের জামাকাপড় গুছিয়ে তিনি তাকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী পারুলকে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। পরে সাত-পাঁচ কিছু চিন্তা করে পারুল বেগম রাজি হয়ে যায়।
মস্ত বড় বাসার স্টোর রুমে জায়গা হয় ছোটনের। সেখানেই সে গুটিশুটি হয়ে পড়ে থাকে। তাকে স্টোর রুমে জায়গা দেয়ায় তার চাচা প্রতিবাদ করলেও পারুল তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করে নি। যাক ছেলেটা থাকার জায়গা পেয়েছে, দুমুঠো খেতে তো পারবে। এখন কথা বেশি বাড়ালে হয়তো পারুল আর তাকে এখানে থাকতেই দিবে না, এই চিন্তা করে আর কথা বাড়ান নি তিনি।
[৩]
ছোটনের মা’কে বিয়ে করার তিন বছর পর তাকে ফেলে রেখে আরেকটি বিয়ে করেন তার বাবা। বিয়ের পর স্ত্রী সন্তানের খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি তিনি। অনেক খুঁজেও তার কোন সন্ধান মিলে নি। কি জানি কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন! ছোটনের মা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। এই সন্তানকে নিয়ে তিনি এখন কোথায় যাবেন! কার দুয়ারে গিয়ে হাত পাতবেন- কথাগুলো চিন্তা করতেই হাত-পা হিমশীতল হয়ে যাচ্ছিলো তার।
অনেক ভাবনাচিন্তা করে তাদের বাসার সামনের এক বাসায় কাজ নেয় সে। অন্তত দুমুঠো খেয়ে পরে, ঘরভাড়া দিয়ে তো চলতে পারবে তারা। ক’দিন ক’জনের কাছে হাত পাতা যায়!
আস্তে আস্তে ছোটন বড় হতে থাকে। তার একটা ভালো নাম আছে। তা হলো আবদুল্লাহ। তবে এই নামে তাকে কেউই চিনে না। মায়ের আদর করে ডাকা ছোটন নামেই সবার কাছে পরিচিত সে।
তার বয়স দেড় বছর থাকাকালীন তার বাবা তাদের একা ফেলে চলে গিয়েছিল। এখন তার বয়স ছয় বছর। জানুয়ারি মাসে মাদরাসায় ভর্তি করানো হয় তাঁকে। সে ছাত্র হিশেবে বেশ ভাল। মোটামুটি কষ্টেসৃষ্টে দিনাতিপাত করছিলো তাঁরা। কিন্তু তার মা তাঁকে কোনদিন কোন কষ্ট আঁচ করতে দেন নি। শত কষ্ট হলেও তিনি নিরবে তা হজম করে যেতেন।
সারাদিন বাসাবাড়ির ধোয়া-মোছার কাজ করতে করতে শ্বাসকষ্টের রোগ বাঁধিয়ে ফেলেছেন তিনি। গেছে বছর শীতে বেশ কষ্ট পেয়েছেন তিনি। ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার সাহেব বেশ দামী দামী ঔষধ দিয়েছে। তার পক্ষে কি এতো দামী ঔষধ কেনা সম্ভব! তারপরও ছোটনের দিকে চেয়ে মাঝেমাঝে দু’একটা ঔষধ কিনে খেতেন।
[৪]
দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। ছোটনের বয়স এখন দশ বছর। বেশ বুদ্ধিমান বালক সে। মায়ের আদরের সন্তান। আদর না করেই বা কোথায় যাবেন! ছেলেটি যে তাঁর খাঁটি সোনা হয়েছে। মায়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
এবারের শীতে তার শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা অনেক বেড়েছে। ছোটন কয়েকবার ঔষধ কেনার কথা বললেও কর্ণপাত করেননি তিনি। বেশ কদিন হয় থেকে থেকে শ্বাস উঠে যাচ্ছে। এই শুক্রবার তো শ্বাসের জন্য কথাই ঠিকমতো বলতে পারছিলেন না তিনি। অনেক কষ্টে ছোটনকে ডাক্তার ডাকার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ডাক্তার আসতে আসতে অনেকটা দেরী হয়ে গেলো।
[৫]
ছোটন তার চাচার বাসায় আসার পর থেকে তার চাচী কাজের মহিলাকে ছাটাই করে দিয়েছেন। তার কথা হলো- এই ছেলেকে কি এভাবে এভাবে খাওয়াবো নাকি আমি! তার বিনিময়ে তাকে সংসারের কাজ করে দিতে হবে। ছোটন অবশ্য এ সিদ্ধান্ত হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিল।
তার মাদরাসার পড়াও এখন আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর মা থাকলে হয়তো কষ্টেসৃষ্টে হলেও তার পড়ালেখা চালিয়ে যেতো। কিন্তু তার মা তো এখন আর নেই। কে এতো কষ্ট করবে তার জন্য!
সেদিন আফজাল সাহেব তার ছেলেদের জন্য চকলেট এনেছিলেন, সাথে ছোটনের জন্যও একটা এনেছিলেন। কিন্তু তার চাচী তাকে আর তা খেতে দেয় নি। হাত থেকে কেঁড়ে নিয়ে তার চাচাকে ইচ্ছে মতো কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছিল।
“বলি তোমার কি টাকা-পয়সা খুব বেশি হয়ে গিয়েছে যে এভাবে অপাত্রে তা অপচয় করছো! দরকার হয় এই টাকার সাথে আরও কিছু টাকা যোগ করে আমাদের ছেলেদের জন্য দুটো চকলেট নিয়ে আসতে। তুমি আনতে গেছো ওই সস্তা ছেলেটার জন্য! এভাবেই তো ঘাড়ের উপর বসে খায় ছেলেটা!” কথাগুলো কানে এসেছিল ছোটনের। তার চাচা এসব কথার প্রতিবাদ করলেও কোন কাজে আসে নি।
সেদিন সে আড়ালে অনেক কেঁদেছিল। দু’দিন আগে থালাবাসন ধুতে গিয়ে হাত থেকে একটা প্লেট পড়ে ভেঙে গিয়েছিল বলে চাচী সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয় তার গালে। আড়ালে কাঁদলেও এর কোন প্রত্যুত্তর করে নি সে। কারন তার মা ছোটকাল থেকে তাকে শিখিয়েছিল যে, যদি কেউ কিছু বলে তবে তাদের সাথে যেন সে পাল্টা জবাব না দেয়।
সর্বাবস্থায় যাতে সে- إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ পাঠ করে।
তার মা‘কে ও সে সর্বদা এই আয়াতটি পাঠ করতে শুনেছিলো।
আজ তাঁর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। তাইতো জামাকাপড়ের ব্যাগ থেকে মায়ের পুরোনো শাড়িটা বের করে তার গন্ধ শুঁকে যাচ্ছে। তার মা থাকলে হয়তো তাকে আজ এতো কষ্ট করতে হতো না।
চাচা-চাচীর সংসারে আগাছা হয়ে থাকতে হতো না।
[৫]
বিকট শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে বেড রুমের দিকে দৌড় দিলো পারুল বেগম। গিয়ে দেখে সিলিং ফ্যান মাথার উপর থেকে সোজা তার বাচ্চার শোবার জায়গায় পড়েছে। তিনি রান্না করতে যাওয়ার আগে সেখানেই তার নবজাতক বাচ্চাকে শুইয়ে রেখে গিয়েছিলেন। ছোটনকে অবশ্য তার কাছে রেখে গিয়েছিলেন।
শব্দ শুনে ছোটনও অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে যায়। তার চাচাতো ভাইকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কান্না করে দেয় সে। আজ যদি ফ্যানটা এই শিশু বাচ্চাটির গায়ের উপর পড়তো তবে কি অবস্থা হতো তা চিন্তা করতেই গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে যাচ্ছিলো তার।
নিজের ছেলেকে ছোটনের কোলে দেখতে পেয়ে প্রান ফিরে পায় পারুল বেগম। ছেলেকে ছোটনের হাত থেকে নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগেন তিনি। নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো তার। যে ছোটনকে সে এতোদিন যাবত অবহেলা করে আসছিলো, উঠতে বসতে কতই না কথা শুনিয়েছে সে-ই কিনা আর তার আদরের সন্তানকে এতো বড়ো একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা (রক্ষা করার মালিক আল্লাহ। মানুষ তো কেবল মাধ্যম মাত্র) করেছে।
ছোটনকে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো পারুল বেগম আর বললো, এখন থেকে তুই আর স্টোর রুমে থাকবি না। তুই তোর ভাইয়াদের রুমে ঘুমাবি। কেমন?
তোকে চিনতে আমার অনেকটা ভুল হয়ে গিয়েছে রে! তুই আমাদের জীবনে আগাছা নস বরং তুই আমাদের জীবনে বটগাছের ভূমিকা পালন করছিস।