সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণ। আর সভ্যতা হলো সেই জাতির দেহ স্বরূপ। প্রাণহীন দেহসত্তার যেমন কোনো মূল্য নেই, দেহহীন আত্নাও তেমনি মূল্যহীন। তাই বলা যায়, সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনেকাংশে পরষ্পরের পরিপূরক। কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে আধুনিক বিশ্বে প্রতিযোগিতার ময়দানে একটি উন্নত জাতি হিসেবে পরিভ্রমণ করার জন্য সংস্কৃতির চর্চা ও মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সংস্কৃতিহীন জাতি প্রাণহীন জড় পদার্থের ন্যায়। যার কোনো কিছু করার ক্ষমতা থাকে না।
কোনো আত্না যদি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, তাহলে সে আত্না যেমন ধীরে ধীরে অপ্রত্যাশিত, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য গতিতে চিরস্থায়ী বাস্তবতা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, ঠিক তেমনি একটি জাতির আত্না নামক সংস্কৃতি যদি অপসংস্কৃতির মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তাহলে সে জাতিও ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে কিংবা অন্য জাতির উপনিবেশে পরিণত হবে, সন্দেহ নাই।
মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় দেশ। এ দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ একত্রে বসবাস করে। আর এর ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার কারণেই এদেশে গ্রহণীয় সংস্কৃতি ইসলামী ভাবধারার হওয়ায় স্বাভাবিক। যার মূল সুর হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। যার জন্য মানুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকৃতিগতভাবে সেদিকেই ধাবমান। কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতিমনা ও সুবিধাবাদী কিছু বুদ্ধিজীবীদের প্রহরায় ইসলামী সংস্কৃতির মূলস্তম্ভ তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের শিক্ষা থেকে জাতি আজ অন্ধকারে নিমজ্জিত। অন্যদিকে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস দেশের সহজ-সরল মানুষদেরকে অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে ও সাক্ষাৎ ধ্বংসের মুখে নিপতিত করছে।
তথাকথিত আধুনিকতা, অপসংস্কৃতি ও সভ্যতা নামের অন্ধকার বেড়াজালে বন্দি হয়ে, মুসলিম জাতি আজ হতাশাগ্রস্ত ও স্তম্ভিত শুধু নয়, মুসলিম জাতি হারিয়ে পেলেছে নিজেদের গৌরবান্বিত ঐতিহ্য আর প্রতিনিয়ত নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের উন্নত সংস্কৃতি।
ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী সাম্রাজ্যবাদীদের দর্শনের হিংস্র থাবা, মুসলিম জাতির সামনে পুজিঁবাদের টোপ ফেলে ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে আরো গরীব বানানোর সুদূরপ্রসারী জালে আটকে ফেলেছে, তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিধ্বংসী হুংকার মুসলিম জাতিকে করেছে পদচ্যুত, নির্লিপ্ত ও পরনির্ভরশীল।
পরনির্ভরশীল বা ঋণের জালে আটকে পড়ে মুসলিম বিশ্ব আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বিশ্ব শকুনদের হাতে যেমনি বন্দী হয়েছে তেমনি সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে ঈর্ষান্বিত গৌরব, ঐতিহ্য ও নির্মল চরিত্র হয়েছে কলুষিত।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক ডা. লুৎফর রহমান বলেছেন, “কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে সে জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আগে ধ্বংস কর”। অন্যদিকে ইহুদী পণ্ডিতদের প্রোটোকলে লেখা রয়েছে, “সর্বত্র আমাদের (ইহুদীদের) নিজেদের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলমানদের নৈতিক চরিত্রে ব্যাপক ভাঙ্গন ও বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।” [ সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ(রহ.) লিখিত ‘বিংশ শতাব্দীর জাহেলিয়াত’ অনুবাদ : মাওলানা আব্দুর রহীম (রহ.) ]।
তারই ফলশ্রুতিতে আজ প্রগতিবাদীরা মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করার জন্য উন্নত সংস্কৃতি ও নৈতিক চরিত্রে ভাঙ্গন ও বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য ধীর অথচ দৃঢ়ভাবে নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে। তাদের এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংস্কৃতির নোংরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কিছু মুসলিম নামধারী এদেশীয় দোসর, তল্পিবাহক ও ক্রীড়নকদের। যা আমরা বিভিন্ন লেখকের লেখায় দেখতে পাই।
উপরোক্ত পেক্ষাপটকে সামনে রেখে বলা যায় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিবাদীদের সংস্কৃতি নামে মুসলিম আক্বীদা-বিরোধী ও চরিত্রহননকারী অপসংস্কৃতির মায়াজালে বন্দী হয়ে মুসলিম সংস্কৃতি তার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। কিন্তু হতভাগা মুসলিম জাতির এখনও নিদ্রা ভাঙ্গেনি।
দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহদাংশ আজ অপসংস্কৃতির মরণ থাবার খোরাকে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন পরিবার, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পিতা-মাতার অসচেতনতা, সমাজ সংস্কারমুক্ত চিন্তাধারা, দারিদ্রের হিংস্র ছোবল, খাম-খেয়ালিপনাসহ সবোর্পরি বিদেশী অপসংস্কৃতি উক্ত করুণ পরিণতির জন্য মূলত দায়ী।
আজকাল দেশের দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই দেখা যায় যে, দেশের সর্বত্রই খুন, গুম, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হচ্ছে। আদরের সন্তানের হাতে নৃশংস ও নির্মমভাবে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে অসচেতন পিতা-মাতা, প্রেমের মোহে কঠিন ভালবাসার আবেগে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও যৌতুকের ফাঁদে আটকে পড়ে; কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সর্বত্রই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারীর হাতে যৌন হয়রানির শিকার নিম্নপদস্থ কর্মচারী।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের খবর আজকাল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার মাত্র। পরকীয়া প্রেমের হিংস্র ছোবলে ধর্ষিতা যুবতীর লাশ বার বার আঘাত হানে বিবেকের দরজায়; এ্যাকশনী ফিল্মের প্রভাবে আজ ছোট্ট শিশু প্রাণ হারাচ্ছে তারই বন্ধুদের হাতে। সারারাত উপর্যুপরী ধর্ষনের শিকার হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে অসাবধান রমণী। স্বামীর সামনে সন্ত্রাসীরা সারারাত পালাক্রমে ধর্ষণ করে হত্যা করছে যুবতীকে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এসিড নিক্ষেপে ঝলসে দিচ্ছে তরুণীর মিষ্টি চেহারা। এরকম হাজারো সন্ত্রাস চলছে দেশে। তাছাড়া সন্ত্রাসের জয়জয়কার চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়ও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানকেন্দ্রে ছাত্রদের মতো ছাত্রীরাও জড়িয়ে পড়ছে মরণব্যাধি নেশার জগতে। আর নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য অনেকে কর্ম হিসেবে বেছে নিচ্ছে পতিতাবৃত্তিকে। যুবসমাজের অবক্ষয়ের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ আর কি হ’তে পারে?
উপরোক্ত পরিস্থিতি অবলোকন করলে একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি সত্যিই তার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলবে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেশ এখন ক্রমান্বয়ে রসাতলের দিকে তথা ধ্বংসের অতল গহ্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে বিবেক পরাহত, চিন্তাশক্তি নিষ্ক্রিয়, পরিবেশ দূষিত, মানবতা স্তম্ভিত। সবোর্পরি দেশের আপামর জনসাধারণ অপসংস্কৃতির অক্টোপাশে জড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে এখন সত্যের আমোঘ বাণী হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় টিভি চ্যানেল, স্যাটেলাইট, টেলিফোন, মোবাইল প্রভৃতিসহ ইন্টারনেট, কম্পিউটারের মত বিস্ময়কর আবিষ্কার বর্তমান আধুনিকতা ও সভ্যতাকে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। যার নেগেটিভ ও পজেটিভ দু’টি দিকই রয়েছে। আধুনিকতার উৎসাহে ও সংস্কৃতির উদ্দীপনায় অধিকাংশ যুবক নেগেটিভ বা খারাপ দিক সমূহ পিপাসার্ত পাখির ন্যায় গোগ্রাসে গিলছে প্রতিনিয়ত। যার কারণে সাক্ষাৎ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে যুবসমাজ আর বিলীন হয়ে যাচ্ছে জাতির শক্তি ও নিজস্ব সংস্কৃতি।
তরুণ সমাজ কেন আজ এ পথে? কেন দৃঢ়চিত্ত সত্ত্বেও আদর্শ পথ থেকে তারা পদস্খলিত? কেন যৌবনের শক্তিমত্তা আজ অন্যায়-অপরাধমূলক কাজে ব্যয় হচ্ছে? কে এর জন্য দায়ী? কারা এদের পিছনে মদদ দিচ্ছে? কে তাদের লালন করছে? কী তাদের পরিচয়?
তাদের শক্তি কি?
হে যুবক! তুমি কি জান?
তুমি কোন জাতির বংশধর?
তুমি কি জান পৃথিবীর মানচিত্রের প্রথম আর্কিটেক্ট কে?
ইউরোপের গর্বিত বিজ্ঞান ও সভ্যতার উৎকর্ষতার পিছনে কাদের অবদান?
বীজগণিত থেকে শুরু করে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম আবিষ্কারক কোন জাতির সন্তান ছিলেন?
তারা তো আর কেউ নয়, তারা হলেন মুসলিম জাতির গর্বিত সন্তান।
যে জাতির আঙ্গুলি হেলনে প্রবল পরাক্রান্ত রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের রাজ মুকুট খসে গেছে। সেই একই জাতির মধ্যে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফীঈ, ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইবনে হাজার আসকালানীদের মত শত সহস্র ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসের জন্ম হয়েছিল (আল্লাহ সকলের উপর রহম করুন)।
এরূপ ঈর্ষান্বিত ক্ষমতা, গৌরবান্বিত ঐতিহ্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিগ্বিজয়ী ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কেন ইসলামী সংস্কৃতি থেকে অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনে নিজেকে নিক্ষেপ করেছো? কেন আজ ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের ক্রীড়নক হয়ে তাদের গোলামে পরিণত হয়েছো? এর জবাব কে দিবে?
হে মুসলিম জাতির অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিহত শক্তির অধিকারী! তুমি না আল্লাহর বান্দা, তাঁরই গোলাম, তুমি না দুনিয়া কাঁপানো শ্লোগান ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্’ এর স্বীকৃতিদাতা মুসলমান?
তাহ’লে কেন তোমার এই বেহাল দশা?
অতএব, হে অবুঝ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিমনা ভাই ও বোনেরা! সময় থাকতে সময়ের মূল্যায়ন করুন। যাবতীয় অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে চল জান্নাতের পানে। জান্নাতুল ফেরদাউস তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
হে যুবক! তোমার প্রতিফোঁটা রক্ত আল্লাহর দেয়া পবিত্র আমানত। আর তা ব্যয় করতে হবে নির্ভেজাল তাওহীদের পথে। গৌরবান্বিত ঐতিহ্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা ও স্থায়ীত্ব দেওয়ার মানসে সর্বোপরি পরকালীন মুক্তির স্বার্থে দল-মত, সাদা-কালো, আশরাফ-আতরাফ, আরবী-আজমী সকল প্রকার বর্ণবৈষম্য ভুলে গিয়ে সকলেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় আবারও দৃঢ় পদক্ষেপে ও অতি সন্তর্পণে সামনে অগ্রসর হই। তাহ’লে দেশ থেকে অপসংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন হবে। মুসলিম সংস্কৃতি জাগ্রত হবে।
ইসলামী ঐতিহ্য ফিরে আসবে। যদি যুবসমাজ তাদের তেজদীপ্ত শক্তিমত্তা কাজে লাগায়, তাহ’লেই সুখী সমৃদ্ধ ও সোনার বাংলাদেশ গড়ার পথ সুগম হবে। আল্লাহ আমাদের সবাই তাওফীক্ব দিন।
আ-মী-ন!!