Writing

ভ্রান্তিবিলাস

ফজরের আযান হলো। চোখ খুলেই দেখি পাগলীটা কি সুন্দর করে খুকীর মতো ঘুমাচ্ছে। খোলা বাতায়নের স্নিগ্ধ পবনে ওর এলোকেশ গুলো সুন্দর মুখটাকে হালকা ঢেকে ফেলেছে। আলতো করে চুলগুলো সরিয়ে আধো আলো আধো ছায়ার সেই মিষ্টি ক্ষণে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। বিয়ের পর থেকে প্রতিটি দিনই ওকে এভাবে দেখি, কেন দেখি তা জানিনা, তবে যত দেখি তৃষ্ণা আরও বেড়ে যায়। মনে হয় নিষ্পাপ সুন্দর মুখটার দিকে আজীবন তাকিয়ে থাকি……

ঘুমালে ওকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে । রুপকথায় লাল পরী, নীল পরীর গল্প অনেক শুনেছি কিন্তু আমার দুধে আলতা রঙের মিষ্টি পরীটার সাথে তাদের কোনো তুলনাই হয়না! ওর টানা টানা চোখে চোখ রাখলে গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে বটবৃক্ষের শীতল ছায়ার মতো মনে হয়, হাজারো ক্লান্তিতে যার ছায়ায় একটুখানি জিড়ানো যায়….!

অবশেষে দুষ্ট-মিষ্টি চিন্তার ঘোর কাটিয়ে আমাকে জড়িয়ে রাখা ওর হাতটি সরিয়ে উঠতে যাবো এমন সময় ও দু-চোখ খুলে এক চিলতে মিষ্টি হাসি দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো……….।

প্রিয় তরুণ পাঠক, আপনাকেই বলছি! উপরের কল্পিত দৃশ্যায়নের মাঝে কতো গুলো অসংগতি লুকিয়ে আছে আবেগের ঘোরে তা খেয়াল করেছেন কি? শরীয়ত ও বাস্তবতার সাথে উপরের রোমান্টিক দৃশ্যায়ন কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ ভেবে দেখেছেন কি? ইসলামি রোমান্টিক গল্পের আড়ালে অসংখ্য ভুল মেসেজ ও বাস্তবতা বিবর্জিত আবেগ তরুণ সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি ফেসবুকের সুবাদে তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পাঠকদের সুস্থ ও ইসলামি ভাবধারার সাহিত্যে আগ্রহী করার অযুহাতে এমন লেখনী কতটুকু যৌক্তিক ও শরীয়াসম্মত সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এবার আসুন উপরের দৃশ্যটাকে বাস্তবতার সাথে একটু মিলিয়ে নেই।
সারারাত ঘুমানোর পর প্রত্যেক মানুষকে বাহ্যিকভাবে সবচেয়ে বিশ্রী, এলোমেলো ও নোংরা মনে হয়। দুধে আলতা রঙের(?) পরীটিও তখন অদ্ভুতুরে হয়ে যায়। ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরে নানা জড়তা নিয়ে সব মানুষ আধা খোলা চোখে ব্রাশ-পেস্ট ও ওয়াশরুমের দরজা খুঁজতে থাকে অথচ সে কিনা ঘুমিয়ে থাকা আরেকটা মানুষের দিকে মিনিটের পর মিনিট অপলক চেয়ে থাকে….এটাও কি সম্ভব বলেন?

চোর বা মশার উৎপাতে মানুষ আজকাল জানালা বন্ধ তো করেই উপরন্তু মশারী টাঙিয়ে ঘুমায়। ম্যাজিক মশারীর ছিদ্র দিয়ে আসা বৈদ্যুতিক পাখার গরম হাওয়া ছাড়া খোলা বাতায়নের স্নিগ্ধ পবন কই থেকে আসবে বলেন?!

দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে ডিমলাইটের আলো ছাড়া প্রকৃতির আধো আলো কিভাবে আসবে? তাও সে আলোতে আবার বধূর দুধে আলতা রঙের নিখুঁত চাহনীও দেখা যায়, কি আশ্চর্য!

যদি ধরেও নেই জানালাটা খোলা ছিলো, কিন্তু ভোরের মৃদু বাতাসে বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষের মাথা এলোকেশী হওয়া আদৌ সম্ভব কি?
যার বধূর টানা চোখ ও গায়ের রং দুধে আলতা নয় সে কি ভালোবাসার উপযুক্ত নয়? দ্বীনদার বিশ্ব সুন্দরী পাওয়ার ফ্যান্টাসী রোগে আমরা আক্রান্ত নই তো?

গল্পের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটা হলো আযান হওয়ার পরও নামাজের প্রস্তুতি না নিয়ে সে অহেতুক আবেগে জড়িয়ে আছে,তাও আবার প্রতিটা দিন! এটা নেক সুরতে শয়তানের ধোঁকা মাত্র। অথচ রাসূল সাঃ আযান শোনার পর সালাতকে দুনিয়ার সবকিছুর উর্ধ্বে প্রাধান্য দিয়েছেন।

দ্বীনদার স্ত্রী তো সে,যে আযানের পর তার স্বামীকে দ্রুত মসজিদে পাঠায়। কিন্তু উপরিউক্ত দৃশ্যে স্ত্রীর উল্টো কাজটি কি স্বামীকে দ্বীনের ব্যাপারে অসহযোগিতা নয়?

কল্পিত এই দৃশ্যে আরও অসঙ্গতি আছে, পাঠক মন দিয়ে পড়লেই তা উপলব্ধি করতে পারবেন। বর্তমানে বিভিন্ন তরুণ লেখকদের রোমান্টিক লেখাগুলো পড়লে এমন অনেক অসঙ্গতি চোখে পড়ে। প্রবৃত্তি পূজারী কবি সাহিত্যিকদের অনুকরণে তারাও ইসলামী ভাবধারায় কল্পিত রোমান্টিক দৃশ্যায়ন করে তরুণ হৃদয়কে আলোড়িত করছে। পাঠকরা এসব অবাস্তব ফ্যান্টাসি হৃদয়ে ধারণ করে যখন বিয়ে করে তখন অনেকেই তার পার্টনারের রোমান্টিকতা নিয়ে অভিযোগ তোলে। ফলে স্বামী/স্ত্রীর ব্যাপারে হৃদয়ের কোণে একটু অতৃপ্তি রয়েই যায়!

তার মানে এই না রোমান্টিকতাকে বিসর্জন দিয়ে দাম্পত্য জীবনকে একঘেয়ে বানিয়ে ফেলতে হবে। প্রত্যেকেই তার পার্টনারকে সর্বোচ্চ রোমান্টিক হিসেবে পেতে চায়,এটা মোটেও দোষের নয়। বরং রোমান্টিকতা ধারণ করা প্রতিটি স্বামী/স্ত্রীর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু লেখকের কলম যখন বাস্তবতার সীমা উতরিয়ে যায় তখন তা আর গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকে না।

প্রিয় নবীর(সাঃ) দাম্পত্য জীবন স্টাডি করলে তার রোমান্টিক আচরণের অসাধারণ দৃশ্যায়ন সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সলেহ আল-মুনাজ্জিদ হাফিঃ লিখিত كيف عاملهم النبي صلى الله عليه وسلم বইটা পড়তে পারেন।

নবীজীর সংসার” নামে বইটার কিছু অংশ অনূদিত হয়েছে। ১৪০০ বছর পূর্বেও একজন মানুষ কতটা রোমান্টিক ও কেয়ারিং ছিলেন তা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বইটার আলোকে আধুনিক রোমান্টিকতার রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে পাঠকদের একটি বই উপহার দেয়ার চেষ্টায় আছি।
আল্লাহ তাওফীকদাতা!!

লিখেছেন

Picture of আব্দুল্লাহ আরমান বিন রফিক

আব্দুল্লাহ আরমান বিন রফিক

আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, তাঁর কাছেই ফিরে যাবো!!

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture