Writing

উপলব্ধি

ক্যান্সারে মৃত্যুর মাসখানেক আগে জুমু’আর দিনে আমার স্কুলজীবনের বন্ধু আপেল মাহমুদ শেষবারের মতো কল করেছিলো। আমার কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে সে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললো, “ঢাকা থেকে (রোগের টেস্ট) রিপোর্ট এসেছে। রিপোর্ট ভালো নাহ। মনে হয় আর বাঁচবো না-রে…. মসজিদে আমার (সুস্থতার) জন্য একটু দো’আ কইরো……।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কেঁদেই ফেললো। ওর কান্না মাখা কন্ঠে পৃথিবীতে আরও কিছুদিন বাঁচার আকুতি ও হৃদয়ের আর্তচিৎকার যেন ঠিকরে পড়ছিলো।

প্লাবনে ডুবন্ত মানুষ সামান্য খড়কুটো ধরে হলেও আমৃত্যু বাঁচার চেষ্টা করে যায়। তাই মৃত্যুর কৃষ্ণ সাগরে নিশ্চিত সলিল সমাধি উপলব্ধি করেই সে হয়তো আমার মতো গুনাহগার মানুষের কাছে দোআ চেয়েছিলো যাতে আল্লাহ আরও কিছুদিন বাঁচার সুযোগ দেন।

তিন মাস বয়সী নবজাতক সন্তানকে অসহায় ইয়াতিম বানিয়ে আমার সহপাঠী পৃথিবী ছাড়তে চায়নি। পৃথিবীর কোনো বাবাই চায় না তার সন্তান বাবা-হীন অসহায় জীবন নিয়ে অন্যের আশ্রিত হয়ে বেঁচে থাকুক। কিন্তু মৃত্যুর ক্ষণ যে পূর্বনির্ধারিত নির্মম সত্য! পিতৃত্বের বাঁধন দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা অসম্ভব।

কর্মজীবনে আমি একজন শিক্ষক। ক্লাসের সকল ছাত্রদের মেধাগত স্তর মাথায় রেখে কঠিন বিষয়কে সহজভাবে উপস্থাপন করাই আমার পেশা। মৃত্যু পথযাত্রী বন্ধুটিকে সান্ত্বনা দিতে মস্তিষ্কের অভিধান তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু সান্ত্বনার সহজ ও উপযুক্ত একটি শব্দও আমি খুঁজে পাইনি। তবুও ব্যথিত হৃদয় আর ছলছল চোখে কিছুক্ষণ নীরব থেকে ওকে অভয় দিলাম, বেঁচে থাকার প্রেরণা দিলাম। আমার অগোছালো সেই কথাগুলো যে নিছকই অকার্যকর সান্ত্বনা তা ও ঠিকই বুঝতে পারছিলো। কথা না বাড়িয়ে দো’আ চেয়ে সে কথার ইতি টানলো। এটাই ছিলো ওর সাথে আমার জীবনের শেষ কথা।

যে মিম্বারে দাঁড়িয়ে সেদিন ওর সুস্থতার জন্য দো’আ করেছিলাম, সময়ের ব্যবধানে আজ সেই একই মিম্বারে ওর মাগফিরাত ও জান্নাত প্রাপ্তির জন্য দোআ করলাম। পরকালের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওর কবরে জান্নাতী সমীরণ বয়ে যাক, দয়াময় আল্লাহর কাছে এ দো’আই করি।

এখানেই গল্পের শেষ নয়। আমার বন্ধুটি যেদিন কল করেছিলো সেদিন মসজিদ থেকে ফেরার পথে একটা দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। বেপরোয়া বাইক চালিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এক টগবগে যুবকের রক্তাক্ত ও নিথর দেহটা রাস্তায় পড়ে ছিলো। আমার ধারণা ভুল না হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। এভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া আত্মহত্যার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। জানি না কোন মায়ের সন্তান সে। নিজ সন্তানের এমন বিধ্বস্ত শরীর পৃথিবীর কোনো মায়ের পক্ষে চোখে দেখা অসম্ভব!

সেদিনের দুইটি ঘটনা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। একদিকে আমার বন্ধু “জীবন ও সুস্থতার” মর্ম উপলব্ধি করে নিশ্চিত মৃত্যু গহ্বর থেকে বাঁচতে প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ আরেকজন প্রাণোচ্ছল সুস্থ তরুণ জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে বাইকের পিক-আপ টেনে অবলীলায় নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

দু’জনই রক্ত-মাংসে গড়া মানব সন্তান। অথচ জীবন ও সুস্থতাকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে তাদের চিন্তার মাঝে বিস্তর ফারাক, তাই-না?!

তবে উদাসীনতার দিক থেকে সেই তরুণ বাইকারের সাথে আমার মিল খুঁজে পাই। সে বেপরোয়া বাইক চালিয়ে নিজের ইহকালীন জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর আমি আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী জেনেও হাজারো পাপ করে নিজের পরকালকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছি! মাত্রা বিবেচনায় তার চেয়ে তো আমিই বড় অপরাধী!!

মুসলিম হিসেবে আখিরাতের জীবনকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমার এই আমলহীন বিশ্বাস পরকালীন মুক্তির জন্য আদৌ যথেষ্ট কি?! অথচ বিবেকসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আমার উচিত ছিলো আমার মুমূর্ষু বন্ধুর ন্যায় জীবন, সুস্থতা ও আয়ুর প্রতিটি সেকেন্ডের মূল্য উপলব্ধি করা এবং পরপারের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা।

প্রায় প্রতিটি মানুষই নিজের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। এটা তার মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য। মানুষের এই স্বভাবসুলভ উদাসীন আচরণের প্রতি লক্ষ্য করেই হাজার বছর পূর্বে আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) বলেছেন
“পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটির পূর্বে গনীমত জেনে মূল্যায়ন করো; বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে, দারিদ্রের পূর্বে তোমার ধনাঢ্যতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসরকে এবং মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে।”
(সহীহুল জামেঃ ১০৭৭নং)।

উভয় জীবনের সফলতা ও মুক্তির জন্য এর চেয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দ্বিতীয়টি আর নেই। এই হাদীসটা যতবার পড়ি ততবারই নিজেকে ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারে খুঁজে পাই।
তবে ছাত্রজীবনে পড়া দুটি পঙক্তির মাঝে

আমার হৃদয়ের আকুতি খুঁজে পাই। জনৈক কবি বলেছেনঃ
أحب الصالحين ولست منهم
لعل الله أن يرزقني صلاحا
ভাবানুবাদঃ আমি দ্বীনদারদের ভালোবাসি কিন্তু নিজে তেমন নই,
তবে আল্লাহর কাছে দোআ করি যেন নিজেও দ্বীনদার হই।

লিখেছেন

Picture of আব্দুল্লাহ আরমান বিন রফিক

আব্দুল্লাহ আরমান বিন রফিক

আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, তাঁর কাছেই ফিরে যাবো!!

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture